অন্তঃপুরের অমলিন কথাকার আশাপূর্ণা দেবী

বাংলা সাহিত্যের আপামর পাঠককুল আশাপূর্ণা দেবীকে চেনেন অনন্য কথাসাহিত্যিক হিসেবে। কিন্তু তিনি যে আর-পাঁচজন বাঙালি সাহিত্যিকের মতোই সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন কবিতা লিখে, এ-কথা হয়তো অনেকেই জানেন না। এ-কথাও হয়তো অনেকেই জানেন না যে, অসংখ্য পুরস্কারে নন্দিত আশাপূর্ণা প্রথম পুরস্কৃত হয়েছিলেন কবিতার জন্যই। অথচ, যে পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেখানে একটি মেয়ের কবি-সাহিত্যিক হবার তেমন কোন সুযোগই ছিল না।

আসলে, সাহিত্যিক হতে গেলে সুশিক্ষার সঙ্গে যে অপরিসীম অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়, তা অর্জন করতে দেওয়ার রীতি আশাপূর্ণা যে পরিবারে জন্মেছিলেন, সেই পরিবারে ছিল না। যদিও পরিবারটি মোটেই গ্রাম্য ছিল না, খোদ কলকাতাবাসী, সময়টা ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ; তবুও উত্তর-কলকাতার মধ্যবিত্তসুলভ সেকেলে গোঁড়ামি তাঁদের মধ্যে বহাল তবিয়তে ছিল। মেয়েরা পড়াশুনো শিখলে উচ্ছন্নে যাবে, বাইরের লোকের সামনে বেরোলে সম্ভ্রম হারাবে, কিশোরীকালের পরে অবিবাহিতা রাখলে আভিজাত্য নষ্ট হবে-এই সব আর কী!

ফলত, ওই সব ধ্যানধারণার জাঁতাকলে পড়ে আশাপূর্ণার বাল্যকালে গৃহশিক্ষক বা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনোর বালাই রইল না। তবে তার মধ্যেও 'বালাই ষাট' বলে নিভৃতে পড়াশুনোর একটা সুযোগ তিনি পেলেন। মা সরলাসুন্দরীর কাছে। আসলে, রক্ষণশীল পরিবারের বউ হয়ে আসার আগে মা বাপের বাড়িতে সামান্য কিছু পড়াশুনোর সুযোগ পেয়েছিলেন। তাতেই তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন বাংলা সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠিকা।

 

Ashapurnadebi1

 

মূলত পাঠিকা মাকে দেখেই আশাপূর্ণার মধ্যে পড়াশুনো শেখার আগ্রহ গড়ে উঠল। সেই আগ্রহের জোরেই একদিকে মায়ের কাছে যেমন নিভৃতে বর্ণমালা চিনতে শুরু করলেন, তেমনি গৃহশিক্ষকের কাছে যখন দাদারা পাঠ নিতেন, অন্তঃপুর থেকেই তার যেটুকু শুনতে পেতেন, সেটুকুই গ্রহণ করে নিতেন-এমনি করে প্রাথমিক শিক্ষার আসরে তাঁর অনুপ্রবেশ ঘটল।

কিছুদিন পর যখন পড়তে শিখে গেলেন, তখন মায়ের পড়া বইগুলো সব নির্বিচারে নিজেও পড়ে ফেলতে শুরু করলেন। পেতে শুরু করলেন সাহিত্যের গভীর রসের স্বাদ। সেই স্বাদ পেতে পেতেই ক্রমশ বইপড়া তাঁর এমন সুন্দর একটা নেশা হয়ে দাঁড়াল যে, তা অন্তরলোকে অনায়াসে আলো পৌঁছে দিয়ে অন্তর-চক্ষু খুলে দেবার চাবি হয়ে উঠল।

আসলে, বাবা হরেন্দ্রনাথ গুপ্ত পেশায় ছিলেন ছবি আঁকিয়ে। বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকার প্রচ্ছদে-অলঙ্করণে নিয়মিত তাঁর আঁকা ছবি বেরুত। ফলে, সমসময়ে প্রকাশিত সমস্ত সাময়িক পত্রিকাই তাঁদের বাড়িতে আসত। মা ছিলেন সেই সবের আগ্রাসী পাঠিকা। তাছাড়া বাড়িতেও প্রচুর বই ছিল। সে-সব আগেই পড়া হয়ে গিয়েছিল বলে বাবার নামে মায়ের জন্য তিন-তিনটে লাইব্রেরি থেকে নিত্যনতুন বই আসত। এ-সব মায়ের পড়া হয়ে গেলেই আশাপূর্ণা পড়ে ফেলতেন। এভাবে মায়ের সাহচর্যে তাঁর পাঠপরিধিও ক্রমে ক্রমে বাড়তে লাগল।

সেই সঙ্গে বালিকাবয়সও বাড়তে লাগল। আশাপূর্ণা পা দিলেন তেরোর কোঠায়। ঠিক এই বয়সেই একদিন মনে জাগল লেখক হবার বাসনা। সেই বাসনার আবেগ হৃদয়ে যে দোলা লাগাল, তা ছন্দ বেয়ে পদ্যের পদবন্ধনে আকার পেল। হয়ে উঠল কবিতা। সেটি খাতায় লিখে, বার কয়েক পড়ে নিজেরই বেশ ভালো লাগল। ইচ্ছে জাগল ছাপার হরফে তাকে দেখার।

ক'মাস হল ছোটদের জন্য আশুতোষ ধরের সম্পাদনায় "শিশুসাথী" নামের একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। প্রকাশের সময় থেকেই বাড়িতে তা আসছে। তাতে ছোটদের লেখাও প্রকাশিত হয়। ফলে, ইচ্ছেডানায় ভর করে কাউকে কিছু না-বলে সেখানেই আশাপূর্ণা পাঠিয়ে দিলেন কবিতাটি। মনে মনে এটুকু আশা লালন করতে লাগলেন যে, যদি শিকে ছেঁড়ে, যদি কবিতাটি প্রকাশিত হয়, তাহলে একটা দারুণ ব্যাপার হবে!

 

Ashapurnadebi2

 

যাঁর নাম 'আশাপূর্ণা', তাঁর আশা ব্যর্থ হয় কী করে! ফলে, কবিতাটি প্রকাশিত তো হলই, উপরন্তু সম্পাদকের কাছ থেকে আগামিতে একখানা গল্প পাঠানোরও অনুরোধ এল। এই দুটো ঘটনাই কিশোরী লেখিকাটিকে অভাবনীয় প্রেরণা জোগাল, অনির্বান উৎসাহে অধীর করে তুলল। কাজেই অবিলম্বে শুরু করলেন গল্প লেখা। তারই পাশাপাশি কবিতা রচনাও চলতে লাগল।

এ-সব যখন চলছে, তার মধ্যেই ছোটদের পত্রিকা 'খোকাখুকু'-তে কবিতা-প্রতিযোগিতায় 'স্নেহ' নামের একটি কবিতা লিখে প্রথম পুরস্কারও পেয়ে গেলেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম পুরস্কার। ব্যস, এভাবেই দুরন্ত দৌড়ের পথ পেয়ে গেল তাঁর বিজয়রথের ঘোড়া।

তবে সাময়িকপত্রে কবিতা সে-সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল পাতা-পূরণের বস্তু, যত চাহিদা ছিল গল্পের। পাঠকের চাহিদা সম্পাদকের দাবি হয়ে দাঁড়াল লেখিকার দরজায়। তাতে কবিতা আপনার ধন হয়েই রয়ে গেল আশাপূর্ণার, কথাসাহিত্যই হয়ে উঠল পাঠকের কাছে পৌঁছনোর একমাত্র হাতিয়ার।

এই অবস্থায় বাড়ি থেকে সম্বন্ধ করে পনের বছর বয়সে আশাপূর্ণার বিয়ে হয়ে গেল। এই বয়সেই তিনি রীতিমতো লেখিকা। শৈশব থেকে যৌবন তাঁর জীবন ছিল চার দেওয়ালে ঘেরা। বাইরের অভিজ্ঞতা তাঁর তেমন হয়নি। বাহিরকে তিনি জেনেছেন বই পড়ে। বিয়ের পর নতুন সংসার পেলেন। তাও হল চার দেওয়ালে ঘেরা। তবে সুখের কথা লেখাজোখায় এই চার দেওয়াল তাঁকে কোন বাধাই দিল না। এবং, সংসার আর সাহিত্য তিনিও ন্যায়-পাল্লার মতো সমানতালে বয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে, যা একেবারেই সহজ কাজ ছিল না। আবার, সত্যি বলতে কী, আশাপূর্ণার মতো মানুষীর কাছে এ-একেবারে জটিল কাজও ছিল না...

আসলে মানুষী বলুন, পাঠিকা বলুন, লেখিকা বলুন, দ্রষ্টা বলুন-আশাপূর্ণা ছিলেন অসাধারণ বুদ্ধিমতী। তাই তিনি সাহিত্য রচনায় আপন গণ্ডিটুকু প্রথমেই বুঝে নিয়েছিলেন, অন্তঃপুরের নারীমনের উত্থান-পতন-বিদ্রোহের আগুনকেই তাঁর হাতিয়ার করেছিলেন। বুঝেছিলেন, বাইরের যে দ্রোহ-বিপ্লব সমস্তই আসলে শুরু হয় অন্দর থেকে। বাইরের যে বৃহত্তর রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-জাগরণের আন্দোলন সমস্ত কিছুরই ক্ষুদ্রতম সংস্করণ হল অন্দর। সেই অন্দরকে নারী হয়ে নিত্যদিন সংপৃক্ত থেকে আশাপূর্ণা যেভাবে চিনেছিলেন, সেভাবে পুরুষ সাহিত্যিকেরা কোনদিনই চিনে উঠতে পারেননি, সাহিত্যে এঁকে উঠতে পারেননি। তাই অত্যন্ত মেধার সঙ্গে সাহিত্য করতে এসে আপনচেনা অথচ অন্যের অনাবিষ্কৃত জগতটিকেই অত্যন্ত সচেতন ও সুনিপুনভাবে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছিলেন আশাপূর্ণা।

সচেতন সাহিত্যিক হিসেবে একটা ব্যাপার কিন্তু খুব সযত্নে এড়িয়ে গেছেন আশাপূর্ণা, সেটা হল, নীতিবাগীশের পথ। তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, পূর্বসূরি মহিলা-সাহিত্যিকেরা সামাজিক ছুতমার্গ এড়াতে না-পেরে বা প্রচলিত সামাজিক নীতিরক্ষার প্রচারটাকেই সাহিত্যিকের কর্তব্য ভেবে ভীষণরকমের নীতিবাগীশ হয়ে উঠেছিলেন। এবং তাতে তাঁদের সাহিত্যের খুবই ক্ষতি হয়েছে। তাই নারীমনের কারবারী হয়েও আশাপূর্ণা নিরপেক্ষ দ্রষ্টার ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে যে আধুনিকতা, তা শেষদিন পর্যন্ত তাই অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছিলেন। তাঁর 'প্রথম প্রতিশ্রুতি', 'সুবর্ণলতা', 'বকুল কথা'র মতো সুবিখ্যাত ট্রিলজি থেকে শুরু করে 'দৃশ্য থেকে দৃশ্যন্তরে', 'সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক', 'দিব্যহাসিনীর দিনলিপি', 'চশমা পাল্টে যায়', 'কাঁটাপুকুর লেনের কমলা' প্রভৃতি উপন্যাসে-গল্পে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির চমৎকার পরিচয় পাওয়া যায়।

দৃষ্টিভঙ্গির অনন্যতা তো আছেই, সেই সঙ্গে অন্দরবাসিনী হয়েও তিনি এতরকমের চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যে, ভাবতে গেলে বিস্ময় লাগে। নিত্যদিনের চেনা গণ্ডি থেকে অচেনাকে চিনে নিয়ে পরিবেশন, কেমন করে তা সম্ভব হত? এমন প্রশ্নে আস্তিক আশাপূর্ণা হেসে বলতেন যে, সম্ভব। কারণ, তিনি তো নিজে লেখেন না। তিনি নিছক মা সরস্বতীর 'স্টেনোগ্রাফার'; মা-ই তো তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে সব! আমরা বলি, তিনি স্রষ্টা, তিনি দ্রষ্টা, তাই হয়েছে সম্ভব। আর সম্ভব হয়েছে বলেই তিনি কলোত্তীর্ণা। সমসময় পেরিয়ে অবশ্য পাঠ্য, সহৃদয় পাঠকের কাছে আজও সমান প্রাসঙ্গিক...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...