অমিতাভ দাশগুপ্তের কলম চিরকাল তেজি ঘোড়া

নিজেকে কখনও আড়ালে রাখতে চাননি তিনি। সমাজ এবং সমকাল বিষয়ে তাঁর অবস্থান ঠিক কোন জায়গায় সদা সর্বদা বুঝিয়ে দিয়েছেন স্পষ্ট করে। পাথক আর কবির মাঝখানে কোন আড়াল নেই। অন্তরে-বাহিরে অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রেম , প্রতিবাদ, রাজনৈতিক দর্শন সবটাই।
সময়ের দলিল হয়ে উঠেছিল অমিতাভ দাশগুপ্তের কবিতা। হৃদয় থেকে উঠে আসা আগুনে শব্দগুলোকে কখনও পেলবতার পশম পরাতে চাননি তিনি।
কবিতা তাই হয়ে উঠেছে উদ্ধত। কবি তাই বলে ওঠেন,
“একটা ছেলেকে ফলো করতে করতে
আমার স্বপ্ন ক্লান্ত হয়ে গেছে।
গোড়ালি-ছেঁড়া পাজাম
আর মভ্ রঙের পাঞ্জাবি পরা
সেই ছেলেটির মুখ কখনো দেখা যায় নি।
স্রেফ ঐটুকু জায়গা
সে ছায়া দিয়ে সব সময় চেপে রেখেছিল...”

এই কবিতার শেষ পর্যন্ত যে দিকে বাঁক তা প্রথম পাঠে আন্দাজের বাইরে থাকে পাঠকের। শেষ পংক্তিতে পৌঁছে কানে আসে কবিতার বুক থেকে ছিটকে আসা তীব্র আর্তনাদ!
অমিতাভ এমনই। ভাষা, ভাবনা সবেতেই স্পষ্ট।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের খুব কাছের মানুষ ছিলেন কবি। "প্রাগৈতিহাসিক"-এর লেখক তখন প্রায় জীবনের শেষ পর্বে। শরীরে যন্ত্রণা তীব্র। মাঝি কেবলই ডাক পাঠাচ্ছে নৌকা নোংর ছাড়ার। লিখতে পারছেন না। অথচ লেখার দায় তীব্র। অগ্রজকে লেখার কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন অনুজ অমিতাভ। "হলুদ নদী, সবুজ বন" মানিকের শেষ উপন্যাস।
অমিতাভ দাশগুপ্তের জন্ম ফরিদপুরে। ২৫ নভেম্বর। ১৯৩৫।
তখনও দুই বাংলা ভাগ হয়নি। পড়াশোনার শুরুটাও সেখানেই। ফরিদপুরের ঈশান স্কুলে। পরে চলে আসেন কলকাতায়। ১৯৪৪-এ ভর্তি হলেন টাউন স্কুলে। এক দিকে তাঁর স্কুল বদল চলছে। নতুন শিক্ষায়তনে মানিয়ে নেওয়া। তারপর কলেজ। প্রথমে স্কটিশচার্চ, পরে সিটি। সালটা ১৯৫৪।
প্রচন্ড ঝোঁক ক্রিকেটে। কলকাতায় উঠতি ক্রিকেটার হিসেবে বেশ নামডাকও হয়েছিল তাঁর। বাঁ-হাতি স্পিনার। বরানগর স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে কলকাতার ফার্স্ট ডিভিশন সিএবি লীগ টুর্নামেন্টে।
তবে শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট নয়, শিক্ষকতাকেই বেছে নিয়েছিলেন পেশা হিসেবে। রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ে যোগ দিলেন শিক্ষকের ভূমিকায়।
পাশাপাশি কবিতাও চলেছে আপন স্রোতের গতিতে। যোগ হল রাজনীতি। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ পেয়েছিলেন। কলমে কলমে বিপ্লব। কারাবন্দী হলেন কবি।
কারাগার, ভয় তাঁর কলমের পথকে কোনওদিন বদলে দিতে পারেনি। অমিতাভ দাশগুপ্তের কলম চিরকাল ছুটেছে তেজি ঘোড়ার গতিতে। যার লক্ষ্য সব সময় মানুষ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...