গুরুদাস "শ্রীরামকৃষ্ণ" বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা ছবির দর্শকদের কাছে তিনি ছিলেন স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব, কখনো বা তিনি ছিলেন কালীভক্ত রামপ্রসাদ, কখনো বামাক্ষ্যাপা। মা জগদীশ্বরীর যেন সাক্ষাৎ অনুচর। তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলি এতটাই জীবন্ত হয়ে উঠত, এতটাই মিশে যেতেন চরিত্রের সঙ্গে যে তাঁর আবেগ দর্শকদের আচ্ছন্ন করে ফেলত, দর্শকদের মনে হতো তিনি অভিনেতা নন; তিনি সত্যিকারের কালীভক্ত কোনো মহাপুরুষ। তিনি অভিনেতা গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

অভিনেতা রূপে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাত্রা শুরু ১৯৪৮ সালে নাট্যশিল্পী হিসেবে। সেইসময়ের বিখ্যাত থিয়েটার গ্ৰুপ ছিল কালিকা থিয়েটার। তাদেরই প্রযোজিত নাটক "যুগদেবতা" নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের মনে জায়গা করে নিলেন তিনি। এই নাটকে খুব কম বয়সেই রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন গুরুদাস বাবু। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর অভিনয় দেখেছিলেন দর্শকরা। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর অভিনয়ের প্রশংসা করে এই নাটক সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। লেখা হয়েছিল গুরুদাস বাবুর অভিনয় দেখে মনে হচ্ছে যে মঞ্চে যেন স্বয়ং শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ দেব অবতীর্ণ হয়েছেন। এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় ছিল তার।

সেই শুরু, এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি সিনেমা, নাটক, যাত্রায় অভিনয় করেছেন। প্রধানতঃ ভক্তিমূলক সিনেমায় তাকে নেওয়া হতো মা কালীর ভক্ত কোনো বিখ্যাত মানুষের চরিত্র চিত্রনের জন্য। দর্শকরাও তাঁকে রামকৃষ্ণদেব বা বামাক্ষ্যাপা ধরনের চরিত্রে বেশি পছন্দ করত।

gurudas1

সিনেমায় অবশ্য অভিনয় শুরু করেছিলেন ১৯৪১ সালেই তবে একেবারে ছোট একটি ভূমিকায়। ছবির নাম "বাংলার মেয়ে"। নায়কের ভূমিকায় প্রথম অভিনয় করলেন ১৯৪৭ অর্থাৎ স্বাধীনতার বছরে। সেই বছরেই "স্বয়ংসিদ্ধা" ছবিতে নায়ক হিসেবে কাজ করলেন। এরপর রামী চণ্ডীদাস, কুয়াশা, সাড়ে চুয়াত্তর, নীলদর্পণ, সাবিত্রী সত্যবান, রানী রাসমণি এবং আরো অনেক ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। তবে তাঁর জীবনের বোধহয় সবথেকে বড় কাজ অথবা সিদ্ধান্ত ছিল ১৯৫৪ খ্রীষ্টাব্দে তখনকার নামী অভিনেত্রী মলিনা দেবীর সঙ্গে "এমজি এন্টারপ্রাইজ" নামের একটি নাট্যসংস্থা তৈরি করা। দু'জনের নামের প্রথম অক্ষর নিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই দলের নাম। তাদের নতুন নাটকের দলের প্রথম দুটি নাটক "ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ" এবং "রানী রাসমণি"। নাটকে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব এবং মলিনা দেবী রানী রাসমণির ভূমিকায়। দুটি নাটকই অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করে। মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলল এমজি এন্টারপ্রাইজ নাট্যদলের জয়রথ।

পরবর্তী কুড়ি বছরে অভিনীত হলো আরো বেশ কয়েকটি নাটক। তাদের বেশিরভাগই ইতিহাসাশ্রয়ী বা পৌরাণিক কাহিনী। প্রত্যেকটা সুপারহিট। বাংলার শহরে গ্ৰামে গঞ্জে রমরম করে চলল নাটকগুলো। কুড়ি বছরে অন্তত কুড়ি হাজার শো করেছিল তাদের নাট্যদল। পাশাপাশি চলল চলচ্চিত্রে অভিনয়। খুব বড় নয় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ - এমন বেশ কিছু ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি হল বাবা তারকনাথ, জয় মা তারা, সাধক কমলাকান্ত ইত্যাদি।

বিবাহ করেছিলেন মলিনা দেবীকে। ভবানীপুরে মিত্র ইনস্টিটিউশনের উল্টোদিকে বলরাম বসু ঘাট রোডে একটি বাড়ি কিনেছিলেন মলিনা দেবী। সেখানেই ছিল তাদের নাট্যসংস্থার অফিস। গুরুদাস বাবু এই বাড়িতেই থাকতে শুরু করেন।

একসময় অভিনয় করতে করতে রামকৃষ্ণদেবের ভূমিকায় ক্রমশ অপরিহার্য হয়ে ওঠেন গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এবং তা তাঁর দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করল। অনেক সময় তাঁর সহ-অভিনেতারা লক্ষ্য করতেন যে শ্রীরামকৃষ্ণের হাতের মুদ্রার ভঙ্গিতে তার আঙ্গুলগুলো বেঁকে যাচ্ছে। একই ভঙ্গিমায় বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায়। অনেক ডাকাডাকি করার পর তাঁর সম্বিৎ ফিরত।

মলিনা দেবীর মৃত্যুর পর তার বড় জামাই সমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ওরফে ননীবাবুর সঙ্গে এনএমজি এন্টারপ্রাইজ নামের নাটকের দল খুলে শো চালাতে থাকেন। কিন্তু খুব বেশিদিন আর চলেনি তাদের নাটকের দল। এরপর গুরুদাস বাবু টুকটাক কয়েকটি ছবিতে এবং যাত্রায় অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু তারপর তিনি হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কোথাও আর খোঁজ পাওয়া যায় নি তাঁর। শোনা যায় মা জগদীশ্বরীর খোঁজে পাগল ছেলের মতো ঘুরে বেড়াতেন তিনি। হয়তো সন্ধান পেয়েছিলেন এমন কোনো অজানা পথের এবং রওনা দিয়েছিলেন যে পথের দিশা খুঁজে পাওয়া আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের পক্ষে সম্ভব নয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...