দেবী সিংহবাহিনীর মন্দির প্রথম তৈরি করেছিলেন এই রাজবাড়ির রাজা

সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক। শুনলে মনে হয় ঠিক যেন রূপকথা। রূপকথার মতোই গল্প এই রাজবাড়ির। রাজা-রানীর কথা। সেই সময় সিংহপুর নামে এক রাজ্য ছিল। ‌ সমৃদ্ধশালী এই রাজ্যে ছিল না কোনো অভাব। রাজা সিংহ বাহু এবং রানী সিবলী সেই সময় এই রাজ্য শাসন করতেন। প্রজাদের সন্তানের মতো ভালোবাসতেন তাঁরা।

রাজার দুই পুত্র ছিল বিজয় সিংহ এবং সুমিত্র সিংহ। মূলত সরস্বতী আর তার শাখা নদী সিংহরণ নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল এই সিংহপুর রাজ্য। এই রাজবাড়ির ইতিহাস তেমনভাবে বইয়ের পাতায় পাওয়া যায় না।

বেশ কয়েক বছর রাজত্ব চালিয়েছিলেন এই রাজপরিবারের রাজারা। সিংহপুর রাজ্যের দায়িত্ব সামলানো সিংহবাহু এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরাই এই পরিবারের একমাত্র বংশধর ছিলেন। তারপর কালের স্রোতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এই রাজবাড়ি। তবে যে কয়েক বছর রাজত্ব করেছিল এই রাজারা, সিংহপুর তার সমৃদ্ধির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছিল।

কিন্তু কোথায় এই সিংহপুর? পৃথিবীর কোন প্রান্তে অবস্থিত? এই নিয়ে রয়েছে নানান মতামত। কেউ বলেন এই সিংহপুর আসলে শ্রীলংকার অংশ। সেখানকার রাজা এই সিংহ বাহু। যেহেতু এই রাজপরিবারের রাজবাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে তাই এই নিয়ে নিশ্চিত করে কোন প্রামাণ্য তথ্য নেই। তবে ঐতিহাসিকরা অনেকেই সিংহপুরকে বর্তমানে হুগলি জেলার সিঙ্গুর হিসেবে মনে করেন।

সিংহপুর রাজ্যের রাজধানী ছিল সিংহল পত্তনে। এটি পরবর্তীকালে সিংহল পাটন হিসেবে পরিচিত হয়।

বর্তমান সময়ের সিঙ্গুর ব্লক-এর পুরোটাই ছিল প্রাচীন সিংহল পত্তন। কালের স্রোতে সব বদলেছে। এমনটাই শোনা যায় সময়ের গতিতে প্রাচীন সিংহল পতন এখন একটি গ্রাম সিংহল পাটন, আর বৃহৎ সিংহপুর রাজ্য এখন শুধুই সিঙ্গুর।

সিংহপুর রাজ্য কিন্তু ইতিহাসে বেশ উজ্জ্বল নাম। রাজা সিংহ বাহু ছিলেন দূরদর্শী, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ। তাঁর প্রকৃত সহযোগী ছিলেন রানী সিবলী। তিনিও রাজার সমস্ত ভালো কাজের সঙ্গী ছিলেন। রাজা কৃষি, বাণিজ্য সবক্ষেত্রেই রাজ্যকে উন্নতির পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন। খেয়াল রাখতেন প্রজাদের সমস্ত সুখ-সুবিধার। শুধু তাই নয় তিনি সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কখনো আপোস করেননি। শোনা যায় সেই সময় সিংহপুরের পাশে দুটি জনপদ ছিল, যাঁরা প্রথমদিকে স্বতন্ত্র হওয়ার চেষ্টা করেছিল। এই জনপদ দুটির নাম শিবিরাষ্ট্র ও চেত রাজ্য। এই শিবিরাষ্ট্রই বর্ধমান এবং চেত রাজ্যই বর্তমানে ঘাটাল। পরবর্তীকালে সিংহবাহুর শৌর্যের কাছে তাঁরা পরাজিত হন। মেনে নিয়েছিলেন তাঁর কতৃত্ব।

প্রজাদের কল্যাণ ও সুখ-দুঃখের দিকে নজর রাখতেন সব সময়। তবে প্রজাদের স্বাধীনতা দিলেও পছন্দ করতেন না কোন স্বেচ্ছাচারিতা। কোন অন্যায় আবদার কখনোই প্রশ্রয় দেননি।

রাজা সিংহবাহুর অভ্যাস ছিল ছদ্মবেশে রাজ্য পরিক্রমা করার। শোনা যায় একবার তিনি এমন রাজ্য ভ্রমণ করছিলেন ছদ্মবেশে। হঠাৎ দেখেন এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা কোন সুদখোর মহাজন পাল্লায় পড়েছেন। মেয়ের বিয়ে উপস্থিত। এদিকে সঠিক সময়ে টাকা শোধ করতে পারছেন না সেই বাবা। ফলে মেয়ের বিয়ে বন্ধের জোগাড় হয়েছিল। এমন কঠিন সময় সেই কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে সাহায্য করেছিলেন স্বয়ং রাজা সিংহ বাহু। নিজের কোষাগার থেকে টাকা দিয়েছিলেন তাঁকে। এভাবেই তিনি সাহায্য করতেন নিজের প্রজাদের।

রানী সিবলী লক্ষীমন্ত, ভক্তিমতী‌ ছিলেন। রানীর ইচ্ছেতেই সিংহপুরে গড়ে উঠেছিল দেবী সিংহবাহিনী মন্দির। প্রতিদিন স্নান সেরে রানী প্রথম মন্দিরে পুজো করতেন। তারপর অনাথ প্রজাদের নানান খাদ্য, বস্ত্র দান করতেন।

রাজা ও রানী দুজনেই স্নেহপ্রবণ ছিলেন। তাঁদের ‌ বাৎসল্য ছিল অতুলনীয়। প্রজারাও তাই রানী ও রাজার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন।

দেবী  সিংহবাহিনীর ঘটা করে পুজো শুরু হয়েছিল সিংহ বাহুর সময় থেকেই। পূর্ণিমা তিথিতে রাজা সিংহ বাহু এই সিংহবাহিনীর পুজো করে ব্যবসা-বানিজ্যের কাজে বেরোতেন।

সিংহপুরের রাজার দুই পুত্র ছিল বিজয় সিংহ ও সুমিত্র সিংহ। যদিও অনেক ঐতিহাসিক বলেন রাজার একটি পুত্র ছিল। যাঁর নাম সুমিত্র সিংহ।

তবে কিছু ঐতিহাসিক বিজয় সিংহের অস্তিত্বকে স্বীকার করেন।

শোনা যায় একবার রাজকুমার বিজয় সিংহ এক প্রজার সঙ্গে অন্যায় করেছিলেন। কিন্তু তা স্বীকার করেননি বাবার কাছে। প্রজাবৎসল রাজা ন্যায় বিচারক হিসেবে পুত্র বিজয় সিংহকে সিংহপুর রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর দীর্ঘদিন ফেরেননি।

সুমিত্র সিংহই দীর্ঘদিন এই রাজ্য চালিয়েছিলেন। কিন্তু তখন রাজা সিংহ বাহু রাজ্যপাটের মায়া ত্যাগ করেছেন।  সিংহপুর হারাচ্ছিল তার পুরনো গৌরব। শুরু হয়েছিল পশ্চিমী রাজ্যের আক্রমণ। রাজা সিংহ বাহু ও রানী সিবলী তখন সব ছেড়ে বৌদ্ধ সঙ্ঘে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। প্রজাদের হাজার অনুরোধও তাঁদের আটকাতে পারেনি। এদিকে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মন তখন অনেকটাই নরম হয়েছে বিজয় সিংহের প্রতি। বাবার অনুরোধ ও আদেশে রাজা বিজয় সিংহ ফিরে আসেন সিংহপুরে। অতীত জীবনের করা অন্যায়ের জন্য তখন তিনি অনুতপ্ত। দীর্ঘদিন অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছিলেন। রাজা বিজয় সিংহ শেষ রাজা ছিলেন এই পরিবারের।

এই রাজপরিবারের অনেক কথাই ঐতিহাসিকরা জনশ্রুতি থেকে কল্পনা করে নিয়েছিলেন। তেমন কোন প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তবে বর্তমানের সিঙ্গুরে থাকা এক ধ্বংসস্তূপকে অনেকেই স্তুপ রাজবাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করেন। অনেকের মতে এটি আসলে সিংহপুর রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। প্রামাণ্য তথ্য না থাকলেও এই রাজবাড়ি ও রাজপরিবার আসলে একটি আদর্শ নগরের নিদর্শন।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...