কালী কথাঃ শ্বেতবর্ণা কালিকা রাজবল্লভী দেবী

আজ কালী কথায় আবার গঙ্গাপাড়ের জেলা হুগলিতে, জানব রাজবল্লভী কালীমন্দিরের কথা। হুগলি জেলার হাওড়া-তারকেশ্বর রেলপথে হরিপাল স্টেশনে নেমে বাস ধরে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় রাজবলহাটে। এই রাজবলহাটেই অবস্থিত এক বিখ্যাত কালী  মন্দির রাজবল্লভী কালী মন্দির। রাজবল্লভী দেবীর নামানুসারে এই জায়গাটি রাজবলহাট নামে পরিচিত। রাজবলহাট সংলগ্ন এলাকায় এই দেবী রাজবল্লভী দেবী রূপে পূজিতা হন। ষোড়শ শতকে ভুরশুটের রাজা রুদ্রনারায়ণ রায় এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

দামোদর আর রণ নদী বেষ্টিত গ্রাম রাজবলহাট; ত্রয়োদশ শতকে সদানন্দ রায়ের উদ্যাগেই নদী তীরবর্তী জঙ্গলাকীর্ণ এই এলাকায় বাণিজ্যের উত্থান ঘটান এবং গড়ে তোলেন এক বিশাল হাট। তিনিই রাজবল্লভীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির নির্মাণ করেন। মনে করা হয়, এই রাজবল্লভী দেবী এবং হাট যুক্ত হয়ে হয় রাজবল্লভী হাট নামের উৎপত্তি, পরে কালক্রমে তা হয়ে উঠেছে রাজবলহাট। রাজবলহাট নামটি এসেছে রাজবল্লভী দেবীর নামানুসারে। এককালে বাংলার তাঁত-শিল্পের অন্যতম পীঠস্থান ছিল রাজবলহাট। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনস্থান এখানেই। 

মাতা রাজবল্লভীর দেবীর নামেই মন্দিরটি রাজবল্লভীর মন্দির নামে পরিচিত। কালীমূর্তি বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কৃষ্ণবর্ণা বা গাঢ় নীল বর্ণের মূর্তি। তবে রাজবল্লভী মাতার মূর্তি কিন্তু একেবারেই তেমন নয়। তিনি উজ্জ্বল, অর্থাৎ শ্বেতবর্ণ।

রাজবল্লভী কালীবিগ্রহ ছয় ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট। গঙ্গামাটি দিয়ে বিগ্রহ নির্মিত। ত্রিনয়নী মুণ্ডমালিনী দ্বিভূজা বিগ্রহের ডানহাতে ছুরি ও বামহাতে রক্তপাত্র। কালীমূর্তির ডান পা শায়িত শিবের বুকের ওপরে এবং বাম পা বিরুপাক্ষের মস্তকে স্থাপিত। বিগ্রহটি শ্বেতকালিকা নামেও বিখ্যাত। এই মন্দির চত্বরে রাজবল্লভী দেবীর মন্দির ছাড়াও একাধিক মন্দির রয়েছে। মন্দিরের পাশেই একটি নাটমন্দির আছে। স্থানটি অন্যতম শাক্তপীঠ হিসেবে পরিগণিত হয়।

জাঙ্গিপুর পুলিশ ফাঁড়ির অনতিদূরেই রাজবল্লভী মায়ের মন্দিরের প্রবেশপথ রয়েছে। প্রবেশপথ পেরোলেই এক বিরাট নাটমন্দির। নাটমন্দিরকে ঘিরে রয়েছে চারটি শিবমন্দির। নাটমন্দির পেরিয়ে গর্ভগৃহে প্রবেশ করতেই শ্বেতকালীর মূর্তিটি চোখে পড়বে। মূর্তিটি বিবসনা নয়, নয় চতুর্ভুজাও। দেবীর পরনে স্থানীয় তাঁতিদের বোনা শাড়ি। পায়ের নিচে একটি নয়, বরং দুটি শিবমূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। ডান পা রয়েছে কালভৈরবের বুকের উপরে। আর বাম পা রাখা আছে বিরূপাক্ষ শিবের মাথার উপরে। রাজবল্লভী দেবীর মূর্তি অদ্ভূত এবং মাটির মূর্তি। গঙ্গা মাটি দিয়ে তৈরি হয় এই মূর্তি। বাম হাতের তালুতে আছে একটি সিঁদুরের পাত্র আর কোমরে ছোট ছোট কাটা হাতের মালা। গলায় ঘণ্টার মালা। বিভিন্ন শহর ও গ্রাম থেকে আসা ভক্তরা দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাজবলহাটে মিলিত হয়। সকাল সাতটায় মন্দিরের দরজা খোলে। এগারোটায় পুজো শুরু হয়ে দুপুর দুটোয় ভোগ নিবেদন করা হয়। সাতটায় হয় সন্ধ্যারতি। 

শোনা যায়, বহুকাল আগে যখন এই অঞ্চলের পাশ দিয়ে কংসাবতী নদী বয়ে যেত, তখনই এক সদাগর দেবীর দেখা পান। তিনিই এখানে মন্দির তৈরি করেন। তবে সে কথার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, নিছকই লোককথা। ইতিহাসেও রাজবল্লভী মায়ের মন্দির নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করেন আনুমানিক ১২৪২ সালে ভূরসুটের রাজা সদানন্দ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। আবার অনেকের মতে, মন্দিরের বয়স ততটা পুরনো নয়। ষোড়শ শতকে রাজা রুদ্রনারায়ণ রায় নির্মাণ করেন মন্দিরটি।

তবে রাজবল্লভী মায়ের পুজোর ইতিহাস সুপ্রাচীন, একথা নিঃসন্দেহে স্বীকার করা যায়। একসময় এই অঞ্চলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। তাঁদের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারও ঘটেছিল। সেই সময় থেকেই তান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই পূজার্চনা চলে আসছে। দেবদেবীর সঙ্গে এখানে নীল সরস্বতী এবং তারা মাও পুজো পান। এঁরা দুজনেও বৌদ্ধ দেবী। আবার দুই পুরুষ অবতারের মাথায় পা দিয়ে দাঁড়ানো রাজবল্লভীর শক্তিমূর্তিটিও বৌদ্ধ দেবী পর্ণশবরীর কথা মনে করিয়ে দেয়। সম্ভবত অনেক পরে ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা পান বলেই দেবীর নাম রাজবল্লভী।

আজও রাজবল্লভীর পূজার্চনার রীতিনীতিতে নানান তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ দেখা যায়। নিয়মিত ছাগবলির পাশাপাশি দুর্গা পুজোর অষ্টমী তিথিতে মেষ বলির রীতি বহাল রয়েছে। ছাগ বলি অবশ্য এখানে হাঁড়িকাঠে মাথা রেখে হয় না। বরং ছাগলটিকে ঝুলিয়ে রেখে প্যাঁচ দিয়ে তার মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়। বলির পর গর্ভগৃহের পিছনের খপ্পরে পশুদের দেহাংশ ফেলে রাখা হয়। শোনা যায় এই খপ্পরের জায়গাটিতেই একসময় ছিল রাজা সদানন্দের পঞ্চমুণ্ডের আসন। এখানে বসেই তিনি তন্ত্রসাধনা করতেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের সমস্ত প্রাচীন নিদর্শনই হারিয়ে গিয়েছে। সংস্কারের কারণে অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছে বর্তমান মন্দিরটির বয়স একশো বছরের বেশি নয়।

রাজবল্লভী দেবীর স্বভাবও রাজকীয়। তিনি প্রতি রাত্রে কাঠের পালঙ্কে নিদ্রা যান। রাতে মাঝে মধ্যে তাঁর তামাক সেবনের ইচ্ছাও হয়। তাই মন্দিরের মধ্যেই এক কোণে প্রস্তুত রাখা থাকে গড়গড়া। তবে খাবারের বিষয়ে তাঁর কোন আড়ম্বর নেই। কোনরকম সম্বরা না দিয়ে প্রতিদিন সিদ্ধ ভোগ রান্না হয় মন্দিরের লাগোয়া রন্ধনশালায়। রোজ অন্তত হাজারজন ভক্তকে সেই ভোগ পরিবেশন করা হয়।

রাজবলহাট ছাড়াও কিন্তু আরও দুই জায়গায় শ্বেতকালীর সন্ধান পাওয়া যায়। তার একটি আবার খোদ কলকাতার বুকে। শোভাবাজারের এই মন্দিরটি আনুমানিক অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে নির্মিত হয়েছিল। শোনা যায় তখন এখানে ডাকাতরা পুজো করতেন। ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে তন্ত্রমতে পুজো দিয়ে যেতেন। অপর মন্দিরটি রয়েছে ব্যান্ডেল স্টেশনের নিকটেই। কোন রাজার সঙ্গে তাঁদের কাহিনির যোগ না থাকলেও তাঁরাও রাজবল্লভী। তাঁদের প্রত্যেকের গায়ের রং জ্যোৎস্নার মতো সাদা।

মন্দির থেকে কিছুটা দূরে রাজবল্লভী মাতার বিরাট দীঘি বা পুকুর আছে, যার নাম 'রাজবল্লভী দীঘি'। ভুরশুটের রাজা সদানন্দ রায় এই দীঘি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুধীরকুমার মিত্র তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন – "১৩৪০ সালের ১১ ই আষাঢ় শ্রীফকিরচন্দ্র, মন্মথনাথ ও জহরলাল ভড় মন্দির ভেঙে যাওয়ার পর বহু টাকায় মন্দিরের আমূল সংস্কার করে দেন। ১৩৪৬ সালে তারা পুনরায় মন্দিরের কাছে বিরাট নাটমন্দির নির্মাণ এবং নহবতখানা, গড়, মায়ের পুকুরের ঘাট, মন্দির সংলগ্ন চারটি শিবমন্দির তৈরি করে দেন। দেবী রাজবল্লভী চণ্ডীরই রূপান্তর বলে মনে হয়। 'পীঠনির্ণয়' গ্রন্থে রাজবলহাটকে শাক্তপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং পিঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম 'চণ্ডী' বলে উক্ত হয়েছে। চণ্ডী প্রাচীনকালে অনার্য দেবী ছিলেন, পরে আর্য ও অনার্যের দীর্ঘ সংঘাতের ফলে তিনি লোকসমাজের পূজা হয়েছেন"। 'রাজবল্লভী মাহাত্ম্য' নামে পুস্তকে দেবীর যে বর্ণনা আছে, তা হল :​

মন্দিরে শোভিছে মাতা শ্রীরাজবল্লভী

শরৎ জোৎস্না প্রভা বিশালা ভৈরবী।

বিল্বমালা গলেছুরি ধরে ডান হাতে

প্রসারিত বাম হস্তে পাত্র শোভে তাতে।

রণরঙ্গিনীর মূতি-ভীমা সুনয়না

বরাভয় প্রদায়িনী, প্রসন্ন আননা।

উজ্জ্বল মুকুট শিরে ত্রিলোক জননী।"

কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গলকাব্যে রাজবল্লভী সম্বন্ধে লিখেছেন :

"রাজবোল বন্দি রাজবল্লভীর চরণ।

ইলিপুরে রঙ্গিনী বন্দো হয়ে একমন।।"

রাজবলহাট গ্রামে একটি বিখ্যাত প্রাচীন প্রবাদ আছে। প্রবাদটি হল – "চার চক, চৌদ্দ পাড়া, তিন ঘাট, এই নিয়ে হয় রাজবলহাট"। কথাটির অর্থ হল, চার চক বলতে দফর চক, সুখর চক, বৃন্দাবন চক আর বদুর চক অর্থাৎ চারটি ক্রসিং ; চৌদ্দ পাড়া বলতে নন্দী পাড়া, দে পাড়া, মনসাতলা, শীলবাটি, ভড়পাড়া, উত্তরপাড়া, দিঘিরঘাট, কুমোর পাড়া, বাড়ুজ্যে পাড়া, দাস পাড়া, কুঁড় পাড়া, নস্করডাঙ্গা, সানা পাড়া ও পান পাড়া অর্থাৎ চৌদ্দটি স্থানীয় অঞ্চল ; তিন ঘাট বলতে দিঘির ঘাট, মায়ের ঘাট ও বাবুর ঘাট অর্থাৎ তিনটি স্নানের অঞ্চল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...