আগুন থেকে রেহাই পেতেই বৈশাখ শেষে বাংলাজুড়ে ব্রহ্মার আরাধনা হয়

এ ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা হলেন ব্রহ্মা, কিন্তু তাঁরই দেবালয়ের বড্ড অভাব। প্রজাতি ব্রহ্মা; গোটা দেশে তাঁর মন্দির রয়েছে মোটে একটি। দেশের একমাত্র ব্রহ্মা মন্দিরটি রয়েছে রাজস্থানের পুষ্করে। তবে আরও একটি মন্দির রয়েছে, যা খাতায়-কলমে ব্রহ্মা মন্দির না হলেও সেই মন্দিরে অনেক ভক্তই প্রজাপতি ব্রহ্মার উপাসনায় ব্রতী হন। তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লি থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে তিরুপাট্ট‌ুরের শ্রী ব্রহ্মাপুরেশ্বরার মন্দিরটিতে ব্রহ্মার পুজো করা হয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই মন্দিরে পুজো দিলে ভাগ্য ফেরে। বাংলার দিকে দিকে তাঁর পুজো হয়। বঙ্গে তিনি অগ্নির দেবতা। লক্ষ্মী-জনার্দনের আরাধনা করা ব্যবসায়ীরাই তাঁর পুজো করেন। কামনা থাকে আগুন থেকে রক্ষার। আদপে এ ব্রহ্মাণ্ড পঞ্চভূতের মিশেল। অগ্নি তার অন্যতম উপাদান, হয়তো সে'কারণেই ব্রহ্মাকে তুষ্ট রাখলে আগুনের দানবীয় রূপ থেকে রেহাই মেলে, এ ভাবনা থেকে বাংলার দিকে দিকে শুরু হয় ব্রহ্মা আরাধনা। কোথাও তিনি একা পুজো পান, কোথাও সস্ত্রীক, কোথাও আবার একই সঙ্গে পূজিত হন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বের। ব্রহ্মা পুজোর সময়টাও গোটা বাংলার মোটের উপর এক, বসন্ত ও গ্রীষ্ম মিলিয়ে। কোনও জায়গায় অক্ষয় তৃতীয়ায়, কোথাও বৈশাখের পূর্ণিমায় কোথাও আবার দোলযাত্রায়।

ব্রহ্মা পুজোর কথা বললেই শাক্ত ও বৈষ্ণবের মাটি শান্তিপুরের নাম এসে পড়ে। বছরের পর বছর ধরে শান্তিপুর বড়বাজার এলাকায় সস্ত্রীক ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর পূজিত হয়ে আসছেন। বৈশাখের পূর্ণিমায় শুরু হয়ে পাঁচদিন ধরে পুজো চলে। শান্তিপুরের মতিগঞ্জ বঙ্গের বাণিজ্য মানচিত্রে বেশ সম্মানজনক স্থান পেয়েছিল। মতিগঞ্জ বড়বাজার সংলগ্ন এলাকায় পাটের আড়ত গড়ে উঠেছিল। ১৮৩১ সালের ৩১ মার্চ (১২৩৭ বঙ্গাব্দ, চৈত্র মাস) ওই এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে যায়। আড়ত-সহ বেশ কয়েকটি পাট ও চালের খড়ের ছাউনির দোকান ভস্মীভূত হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অগ্নি দেবতাকে তুষ্ট করতে ব্রহ্মাপুজো শুরু করেন। কিন্তু প্রথমটায় তাতেও রেহাই মেলেনি। বেশ কয়েকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ব্রহ্মাপুজোর পাশাপাশি বিষ্ণু ও মহেশ্বরকেও পুজো করা শুরু হয়। ব্রহ্মার স্ত্রী গায়ত্রী, বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী ও মহেশ্বরের স্ত্রী পার্বতীর পুজো করা শুরু হয়। তারপর থেকে বড় রকমের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা থেকে রেহাই মেলে। মূর্তিতে, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর একই চালচিত্রে যে যার অর্ধাঙ্গিনীকে নিয়ে বিরাজ করেন। ব্রহ্মা-পত্নী বেদমাতা সাবিত্রীর নামে পুজো হয়। বিষ্ণু সঙ্গে লক্ষ্মী ও মহেশ্বর তার পত্নি-পার্বতীকে নিয়ে বিরাজমান।

Shantipur Brahma Puja

বড়বাজারে ব্রহ্মা মন্দিরে শিলালিপি অনুযায়ী পুজো শুরুর সন রয়েছে ১২০১ বঙ্গাব্দ। ১৮৫৩ সালে শান্তিপুর মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষালের আমলে ব্রহ্মা পুজোর সঙ্গেই শুরু হয় ব্রহ্মার বিবাহ অনুষ্ঠান। বৈশাখের পূর্ণিমা তিথির আগের দিন রাতে অর্থাৎ শুক্ল চতুর্দশীতে ব্রহ্মার বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। পুজোর আমন্ত্রণ জানাতে একজন নারদ সেজে ঢেঁকি সহযোগে ময়ূরপঙ্খিতে চেপে শান্তিপুর শহর পরিক্রমা করে। শান্তিপুর শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোর মোড়ে মোড়ে পুজোর প্রচার করা হয়। ঢেঁকির পিঠে চেপে নারদবেশী কেউ ছড়া কেটে নগরবাসীকে ব্রহ্মা পুজোয় নিমন্ত্রণ করেন। গাওয়া হয় ছড়া, পাঁচালি। যা ময়ূরপঙ্খীর গান নামে পরিচিত। লৌকিক গানে উঠে আসে সমসময়ের নানান বিষয়। সঙ্গে থাকে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ অনেকেটা চৈত্র শেষের সঙের মতোই। পুজোয় জলসাধার রেওয়াজ রয়েছে। পুরুষরাই মহিলা সেজে মাথায় কুলো, মঙ্গল প্রদীপ ও কলসি কাঁখে রাস্তায় নামেন। প্রথমে থাকে নারদ। তার পিছনে জলসাধার দল থাকে। প্রচুর মানুষের ভিড় জমে রাস্তার দু'ধারে। বলে রাখি, নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের মালোপাড়া বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পুজোতেও ছেলেরা মেয়ে সেজে জলসাধতে যান। মাথায় কুলো, কাঁখালে কলসি নিয়ে ঘোমটা দিয়ে মধ্যরাতে কালী, শীতলা মন্দিরে গিয়ে গিয়ে পুরুষরা নিমন্ত্রণ করেন। সবশেষে জলঙ্গি থেকে জল নিয়ে ফেরেন তাঁরা।

উত্তর ২৪ পরগণার পানিহাটিতেও দীর্ঘকাল যাবৎ ব্রহ্মার পুজো হচ্ছে, রয়েছে স্থায়ী মন্দির। পানিহাটির বাজারপাড়া চালপট্টি অঞ্চলে রয়েছে ব্রহ্মা মন্দির। বহুকাল আগে চালপট্টির ঘিঞ্জি গুদাম, সংলগ্ন খড়-বাঁশের বাড়িগুলোতে প্রায়ই আগুন লাগত। আগুন থেকে রক্ষা পেতেই শুরু হয়েছিল ব্রহ্মার আরাধনা, শিবচতুর্দশীর দশদিন পর পুজো হয়। 

ব্রহ্মা সঙ্গে মৃন্ময়ী রূপে থাকেন পত্নী সাবিত্রী এবং সরস্বতী দেবী। মন্দিরে স্থায়ী কোনও বিগ্রহ থাকে না। বিসর্জনের পর কাঠামো তুলে এনে রাখা হয়, সেটিই সারা বছর থাকে। 

মুর্শিদাবাদের বড়ঞা থানার সাবলপুর গ্রামে ফি বছর ধুমধাম করে ব্রহ্মার পুজো করা হয়, পুজোর আয়োজন করে অগ্নিবীণা ক্লাব। পুজোর বয়স একশো ছুঁই ছুঁই হবে। পুজো শুরু কারণ সেই আগুন। একদা গ্রামের একের পর এক বাড়িতে আগুন লেগে যেত। আগুনে পুড়ে ছাই হত বাড়ি। মারা যেত মানুষ, গবাদি পশু। আগুনের হাত থেকে গ্রামকে বাঁচাতে এক সন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। সেই সন্ন্যাসীই ব্রহ্মার পুজো করার নিদান দিয়েছিলেন। সেই থেকেই পুজো শুরু। এখানে অক্ষয় তৃতীয়ায় পুজো হয়। 

বঙ্গেই দেখা যায়, অন্য ঠাকুরের সঙ্গেও ব্রহ্মা পুজো পান। হাওড়ার মাঝেরহাটে লক্ষ্মীনারায়ণ দেবের পুজো হয়। শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও আন্দুল রোডের মধ্যবর্তী অঞ্চলটি মাঝেরহাট কলেজ ঘাট রোড নামে পরিচিত ছিল। দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে লক্ষ্মীনারায়ণ দেবের পুজো হয়। ১৮৯৮ সালে শুরু হয়েছিল লক্ষ্মীনারায়ণ পুজো। পুজো এসে পড়েছে স্থাননামেও, এলাকার নাম হয়েছে লক্ষ্মীনারায়ণতলা। কলেজ ঘাট রোডের নাম হয়েছে লক্ষ্মীনারায়ণতলা রোড নামে। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন শুরু হত লক্ষ্মীনারায়ণ পুজো। চলত শ্রাবণ মাসের তৃতীয় রবিবার পর্যন্ত। এখন পুজো শুরু হয় দশহরার দিন। নানা দেব দেবীর সঙ্গে পূজিত হন লক্ষীনারায়ণ। থাকেন দেবাদিদেব মহাদেব ও ব্রহ্মা। একদম উপরে থাকেন দেবী সরস্বতী, তিনি আবার ব্রহ্মা স্ত্রীও। এছাড়া থাকেন জয়া-বিজয়া, গণেশ, দেবরাজ ইন্দ্র, মহর্ষি ভৃগু ও বৃহস্পতি। নারায়ণের বাহন গরুড়কেও দেখা যায়।

বেলগাছিয়ায় বুদ্ধ পূর্ণিমায় পুজো পান ব্রহ্মা। হুগলির চন্ডীতলা থানার কৃষ্ণরামপুর বাজারে দোলযাত্রার দিন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর পুজো। বাজার কমিটির এই পুজোও সুদীর্ঘকাল ধরে চলছে। হুগলির শ্রীরামপুরের চাতরায় শ্রাবণে ব্রহ্মার পুজো হয়। রিষড়া ব্রহ্মার মন্দির রয়েছে, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নবদ্বীপে ঝুলন পূর্ণিমায় ব্রহ্মা পুজো হয়। গ্রীষ্মে নদীয়ার মাজদিয়া, বেথুয়াডহরী মাঠপাড়াতেও ব্রহ্মা পুজো হয়। পূর্ব বর্ধমান গলসির গলিগ্রামে ব্রহ্মা স্থায়ী মন্দির আছে, ২০২৪ তা সংস্কার করা হয়েছে। হাওড়া গ্রামীণের জয়পুরে ব্রহ্মা পুজোও বয়সে বেশ প্রাচীন। কোচবিহারের তুফানগঞ্জ রাণীরহাট বাজারেও ব্রহ্মা পুজো হয়। প্রায় সবটি পুজো ব্যবসায়ীদের উদ্যোগেই শুরু, নেপথ্যে সেই হাট-বাজারে আগুন লাগা থেকে রেহাই পাওয়ার প্রার্থনা।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...