নববর্ষের ছেলেবেলা

নব আনন্দে জাগো আজি নবরবিকিরণে

শুভ্র সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে ॥

উৎসারিত নব জীবননির্ঝর উচ্ছ্বাসিত আশাগীতি,

অমৃতপুষ্পগন্ধ বহে আজি এই শান্তিপবনে

চলে এল আরেকটা নতুন বছর, ১৪২৯। নতুন বছরে নতুন আশা আকাঙ্খা, নতুন দিন, নতুন শপথ — ভালো থাকার, ভালো রাখার। ১৪২৯-এ বিশ্ব হোক করোনামুক্ত। নতুন বছরে কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে কেটে যাক এই বিষাক্ত ব্যাধির কালো বিষাদের মেঘ, বৃষ্টি ধারার মতো সবার জীবনে নেমে আসুক সুখ আর আনন্দ। শুভ হোক এই নববর্ষ। স্বাগত ১৪২৯। সবাইকে জানাই শুভ নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। 

বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। এই দিনটি আপামর বাঙালির কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন। এই দিনটিকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে বিশেষ উৎসবের দিন হিসেবে পালন করা হয়।

এবার আসি সেই দিনগুলোর কথায় যখন বাংলা নববর্ষ মানেই নতুন খুশিতে মেতে ওঠার দিন। সে তো সেই সত্য যুগের কথা। তখন এই নিবন্ধকার একটা দশ বারো বছরের মেয়ে। তখন এই পৃথিবীটাও যেন ছিল কত নতুন। নববর্ষের আগমন টের পেত সেই মেয়েটা যখন চৈত্র মাসের মাঝামাঝি থেকেই শুরু হয়ে যেত ঘর দুয়ার পরিষ্কার করার পালা। ঠাকুমা আর মা, কাকিমা মিলে রান্না ঘরে সব মশলার কৌটো, শিশি, বোতল ধুয়ে মুছে চকচকে করে ফেলত। ছোটদের দায়িত্ব থাকত ঘরের ঝুলগুলো ঝেড়ে ফেলার। আর কাকা কেমন সুন্দর মাথায় কাপড় দিয়ে একটা পাগড়ি লাগিয়ে বাড়ির সবকটা পাখা ঝকঝকে পরিষ্কার করে মুছে ফেলত। জানালা দরজার ধুলোও সব সাফ। আমার মতো ছোটরা বেশ একটা উৎসবের আমেজ টের পেতাম। সব থেকে আনন্দ হত যখন মা চৈত্র সেলের বাজার থেকে নতুন জামা কিনে আনত। তার সঙ্গে মা, কাকিমা, ঠাকুমারও নতুন শাড়িও আসত। কোনটির দামই হয়তো খুব বেশি নয় কিন্তু আমাদের কাছে সেটাই যেন পৃথিবীর সব থেকে বেশি সুন্দর বলে মনে হত। পাশাপাশি আরও একটা বড়ো আকর্ষণ ছিল হালখাতার নেমন্তন্ন। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতাম "বাবা নিয়ে যাবে তো আমাকে সঙ্গে করে"! 

চলে আসত চৈত্র সংক্রান্তি। সেদিন সম্পূর্ণ নিরামিষ রান্না। বাঙাল বাড়িতে টক ডাল, নিম বেগুন, বড়া ভাজা এগুলো হলো চৈত্র সংক্রান্তির বিশেষ আইটেম। চোখ বুজে কোনোরকমে খেয়ে নিতাম। এর পরে আসত সেই বহু আকাঙ্খিত নববর্ষ। সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে নতুন জামাটা পরে নিয়ে প্রথমে ঠাকুর প্রণাম তারপর বাড়ির সব গুরুজনদের পায়ে ঢিপ ঢিপ। সেই দিনটায় কিছু উপার্জনও হত, কারণ বড়রা ছোটদের হাতে দু’টাকা-একটাকা দিতেনই। (সেই টাকাটা পরে স্কুল থেকে ফেরার সময় আলুকাবলি বা আচার খাওয়ার সময় খুব কাজে লাগত।) এরপর দরজায় দরজায় শোলার ফুল ঝোলানো আর সিঁদুরের টিপ দেওয়া।

সকালের জলখাবারে লুচি, নারকেল দিয়ে ছোলার ডাল আর মিষ্টি। সেদিন বেশ কয়েক রকম মিষ্টি আনা হতই। যে মিষ্টি খুশি সেই মিষ্টি খাও। দুপুরে কাতলা বা ভেটকি বা চিতল মাছ থাকবেই। সঙ্গে কখনও মাংস কখনও গলদা চিংড়ি। আমি আর নিরামিষের দিকে বিশেষ মন দিতাম না। কোনও তেতো আইটেম নেই এটা খুব স্বস্তি দিত। শেষ পাতে দই থাকতই।

এবারে সন্ধে বেলা বাবার হাত ধরে ঝুলে পড়া "আমাকে নিয়ে চলোওওওও"। কখনও মুদি কাকুর দোকানে, কখনও ফার্নিচারের দোকানে, কখনও সোনার দোকানে — হালখাতার নেমন্তন্নে গেলেই বেশ বড়োসড়ো একটা বা দুটো প্যাকেট আর নতুন ক্যালেন্ডার। আইসক্রিম বা কোল্ডড্রিংকস তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে খেয়ে দুটো বা তার বেশি প্যাকেট শক্ত করে হাতে ধরে অন্য হাতে ক্যালেন্ডারগুলো নিয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন নিজেকে বিশ্বজয়ী বলে মনে হত। বাড়িতে কত আত্মীয়স্বজন আসত সেদিন। তাদের শুভ নববর্ষ জানানো, সবার সঙ্গে হৈ হৈ করে গল্প করা, হালখাতার মিষ্টির প্যাকেটগুলো খোলার আগে মা'র কানে কানে ফিসফিস করে বলে দেওয়া যেন বড় বড় ভালো মিষ্টি আমার জন্য রেখে দেয় পরদিন খাওয়ার জন্য– কারণ পেটে তো আর জায়গা নেই। এরপর চোখে নেমে আসত ঘুম। বাড়ি ফাঁকা হওয়ার আগেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়তাম। এইভাবেই কেটে যেত নতুন বছরের প্রথম দিন।

পয়লা বৈশাখ এখনও আসে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের কবিতার অংশবিশেষ উল্লেখ করে বলা যায়

"বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের

ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো;"

কাল যে বড় নিষ্ঠুর। তাই সেদিনের ছোট্ট মেয়েটা আজ কতো বড়। তবুও তার নববর্ষের দিন গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করে রবিঠাকুরের সেই অবিস্মরণীয় গান—

"এসো হে বৈশাখ এসো এসো

তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষু রে দাও উড়ায়ে

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক

এসো এসো

এসো হে বৈশাখ"

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...