হেঁশেলে পিঠের ঘ্রাণ

একটা রসগোল্লা-বাঙালি খেলেও খেতে পারে, কিন্তু পিঠে চাই থালাভর্তি। একটা বা এক ধরনের পিঠের কথা বাঙালি ভাবতেই পারে না। কেন? এই ‘কেন’র উত্তরে সটান বলে দেওয়া যায়- ‘আমাদের আছে যে তিনশো রকম!’ শুধু কথার কথা নয়, সত্যি সত্যিই একদিন বাংলায় তিনশো রকম পিঠের চল ছিল। এপারবাংলা ওপারবাংলা দুই বাংলাতেই।

চাল, গম, ডাল, গুড়, দুধ সবকিছু দিয়েই পিঠে তৈরি হত। বাঙালি ঘরে পিঠে কবে থেকে জনপ্রিয় হয়ে উঠলে তার সঠিক সন-তারিখ বা সময়কাল পাওয়া যায় না। তবে ভারতীয় খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠের চল বহু প্রাচীন

 

PithePuli1

সংস্কৃত সাহিত্যে ‘পিষ্টক' শব্দটির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে৷ বাংলায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি কাব্য এবং ময়মনসিংহ গীতিকার কাজল রেখা আখ্যানের সূত্র ধরে বলা যায় গত প্রায় পাঁচশ' বছরেরো বেশি সময় ধরে বাংলার হেঁশেলে পিঠে তৈরির পর্ব চলে আসছে। আজও কান পাতলেই শোনা যায় সেই ‘ছ্যাঁক’ শব্দ। পৌষ আর মাঘ এই দুই মাস ধরে চলে পিঠে-পার্বণমকর সংক্রান্তি এলে আরও জৌলস বাড়ে।

নবান্ন পেরিয়ে ঘরে আসে নতুন ধান। হাওয়ার শীত গায়ে লাগলেই জিরেন হয় গুড়। নতুন ধানের আর নতুন গুড়ের সুঘ্রাণে পিঠে হয়ে ওঠে অমৃত সমান।

পিঠে বানাতে লাগে চালগুঁড়ি। গন্ধ আর আর্দ্রতার কারণে নতুন চাল পিঠের জন্য আদর্শ৷ ধান যত পুরাতন হতে থাকে ততই সে আর্দ্রতা হারাতে থাকে৷ ফলে সেই চালের আটায় তৈরি পিঠা আর সুস্বাদু থাকে না আগের মতো৷

 

PithePuli2

 

হেমন্তে নতুন ধান গোলায় উঠে গেলে মহিলারা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ঢেঁকিঘরে চাল কুটতে। চাল ভেনে গুঁড়ি তৈরি হত পিঠের জন্য।

এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে বয়ে চলে পিঠে তৈরির বিদ্যে। সে অতি গোপন। গৃহস্থ বাড়িতে অত্যন্ত শুদ্ধাচারে পিঠে তৈরি করা হয়। লোকবিশ্বাস, শুদ্ধাচার না মেলে চললে পিঠের স্বাদ তো আসে না, পিঠে বারবার ভেঙে যায়।

অনেক পরিবারে পিঠে তৈরির নিজস্ব প্রণালী থাকে। সেই প্রণালী গোপন আচারের মতো রক্ষা করা হয়। চন্দ্রপুলি, পাটিসাপটা, দুধপুলি, গোকুল পিঠে, মুগসামলি এতো চেনা নাম। কিন্তু আছে আরো অনেক। মুখশলা পিঠা, পানিদৌলা, পাতা পিঠা, চুঙ্গাপিঠা, খাজুর পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, দোল্লা পিঠা, পাকান পিঠা, পোয়া পিঠা, চিতই পিঠা,দুধচিতই, হাতকুলি এমন অজস্র নাম।

 

PithePuli3

‘পিঠা’ হোক বা ‘পিঠে’, অঞ্চলভেদে বদলে যায় নাম। পিঠের নাম এবং তৈরির উপচার দিয়েও বোঝা যায় অঞ্চল গোত্র। শক, হুন, পাঠান, মোগল, ইংরেজ এসেছে, বিশ্ব গ্রামের বাসিন্দা হয়েছে বাঙালি, কিন্তু বদল হয়নি তার হেঁশেলের পিঠের ঘ্রাণ। মকর তিথিতে সূর্যরেখা উত্তরে দিক বদল করলে গোটা দেশ যখন উৎসবে মাতে তখন বাঙালি মেতে ওঠে হেঁশেলের উৎসবে। এই তার শিকড়ের টান। পিঠের গায়ে যে লেগে মায়ের গন্ধ...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...