‘তুই নাকি মা দয়াময়ী’ - কালীপুজোর সময় এইসব গানের কথা বড় বেশী করে মনে পড়ে যায়। এইসব গান ছাড়া কালী পুজোর কথা ভাবাও যায় না। আসলে ‘মা’ শব্দটার এমনই ব্যঞ্জনা ও মহিমা যে ওই একটা শব্দের মধ্যেই আমাদের যাবতীয় সুখ দুঃখ, প্রাণের আরাম ও আত্মার শান্তি মিশে থাকে। দুর্গাপুজোয় যেমন আগমনী গান, কালীপুজোয় তেমনই শ্যামাসঙ্গীত।
আমাদের অনেকেরই বেড়ে ওঠার সঙ্গে প্রতি পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এইসব গান। যে কোনও গানই শ্রোতার প্রিয় হতে একটু সময় নেয়। কিন্তু বারবার শোনার পরে একটা অনুরণন এবং আবেশ তৈরী হয়। সেখান থেকেই জন্ম নেয় ভালোলাগা ও ভালোবাসা। কিন্তু যাঁর শ্যামাসঙ্গীতে কালীপুজোর আকাশ বাতাস মুখরিত হতে থাকে সেই পান্নালাল ভট্টাচার্য সম্পর্কে আমরা ক’জন জানি! আমরা ক’জন জানি যে মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন! কিন্তু যিনি এমন দরদ দিয়ে মায়ের ভক্তিগীতি গান তিনি কেন আত্মহত্যা করতে গেলেন?
পান্নালাল ছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ভাই। দুই ভাই-ই শ্যামাসঙ্গীত ও আধুনিক গানে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তবে দাদা ধনঞ্জয়ের কথামতো শ্যামাসঙ্গীতকেই বেছে নেন পান্নালাল। দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্মানজনক একটা চুক্তি হয়ে গেল। সিনেমা ছাড়া ধনঞ্জয় শ্যামাসঙ্গীত গাইবেন না। ওদিকে পান্নালালও আধুনিক গাইবেন না। এভাবেই সুন্দর দিন কাটছিল। দাদা বা ভাইয়ের মনে একে অপরের প্রতি কোথাও কোনও বিদ্বেষ বা অসূয়া জন্ম নেয়নি। কিন্তু বিধি বাম।
পান্নালালের যখন চারিদিকে বেশ নামডাক হয়ে যায়, তখন কয়েকজন বন্ধু তাঁকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে তাঁর কান ভাঙাতে লাগলেন। তাঁকে বোঝানো হল যে, তাঁর এরকম দরাজ গলা; তিনি যদি আধুনিক গান করেন, তাহলে ধনঞ্জয় আর মার্কেটে টিকবে না। তাই তিনি দাদাকে সরিয়ে দিলেন। অনেকের মতে, পান্নালাল নাকি বন্ধুদের এইসব কথা মনে প্রাণে বিশ্বাসও করেছিলেন।
এই ঘটনার ফলে দুই ভাইয়ের মধ্যে দূরত্ব তৈরী হল। কথাবার্তাও একেবারেই বন্ধ। কিন্তু মোহভঙ্গ হতে বেশী সময় লাগল না পান্নালালের। সাফল্যের পেছনে দৌড়তে গিয়ে নিজের প্রিয়জনকে আঘাত ও তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ হওয়ার ঘটনা পান্নালালকে কিছুটা হতাশ করে তোলে। তাই তিনি মাঝে মাঝেই শ্মশানে চলে যেতেন।
নিজের মনেই অনর্গল কীসব যেন বিড়বিড় করতেন। মনে মনে বলতেন - মায়ের এত গান গাইলাম, তবু মা দেখা দিচ্ছেন না কেন? বাড়িতে তখন স্ত্রী ও দুই মেয়ে রয়েছে। তা সত্ত্বেও তিনি একটু একটু করে উদাসীন হয়ে যেতে লাগলেন। সংসারে থেকেও সংসারের মোহমুক্ত। কোনও কিছুতেই তাঁর যেন কোনও আসক্তি নেই। কোনও কিছুই তাঁকে এক মুহূর্ত শান্তি দিতে পারছিল না। আর ঠিক তার পরেই তিনি নিলেন জীবনের সেই চরম সিদ্ধান্ত। চিরতরে হারিয়ে গেলেন জগৎ সংসার থেকে।
তবে তিনি হারিয়ে গেলেও তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি হারিয়ে যায়নি। যে কোনও সৃষ্টিই তো মানুষকে অমর করে রাখে। যদিও তিনি গেয়েছিলেন ‘সকলি ফুরায়ে যায় মা’ - কিন্তু সত্যিই কি সব ফুরিয়ে গেছে? হয়ত তাঁর অনেক সাধই মেটেনি, অনেক আশা পূরণও হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর গানগুলি আজও বাঙালির প্রাণের সঙ্গী। খুব যত্ন করে আপামর বাঙালি সেই গানগুলোকে মনের মণিকোঠায় ধরে রেখেছে। তিনি হয়ত চলে গেছেন। কিন্তু তিনি দিয়ে গেছেন সেই ভক্তিভাবের ডালি। এক মনে সেই গান শুনে আজও আমাদের চোখ সজল হয়ে ওঠে। ভক্তিভাবের প্লাবনে মন কানায় কানায় পূর্ণ হয়।
যদিও তাঁর গান পরবর্তীকালে রিমেক হয়েছে। অনুরাধা পড়োয়াল, কুমার শানু তাঁর গাওয়া গানই আবার নতুন করে গেয়েছেন। কিন্তু আদি তো তিনিই। অন্যান্যদের জনপ্রিয়তা থাকলেও পান্নালালের জনপ্রিয়তা কোনওদিন ম্লান হবে না। মাত্র ৩৬ বছরে তিনি হারিয়ে গেলেও ওই অল্প সময়ে তিনি বাংলা সঙ্গীত জগতকে তিনি যা উপহার দিয়েছেন তা কোনোদিন ভোলার নয়। তাই পান্নালাল ও তাঁর শ্যামাসঙ্গীত আজও আদি অকৃত্রিম।