কিস্যা-কাবাব কা

দিন কয়েক আগেও শীতকাল শীতহীন বলে হা-হুতাশ করছিল সাধারণ মানুষ। সেই খেদ মিটিয়ে শহরে এসেছে হি-হি শীত। প্রায়দিনই তাপমাত্রা ১১-র নিচে। দিনের আলো নিভলেই ডাল-পালা জোগাড় করে রাস্তার ধারে ওমের আগুন। পুলওভার-টুপি-মোজোয় জমে উঠেছে বাঙালির শীত।  

শীতকাল নেমে এসেছে শহরের কাবাব-তন্দুরির দোকানগুলোতেও। পাঁচতারা  হোটেল থেকে শুরু করে রাস্তার স্টল। সব জায়গাতেই সন্ধে নামলে ঝাঁপিয়ে ভিড়। কাঠকয়লার ধিকিধিকি আগুনে ঝলসানো কাবাবের গন্ধে ম-ম আশপাশ। শীতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় সেই গন্ধ যেন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে।

কলকাতায় কাবাব বললেই পা আপনি চলে যায় অলি-গলির ভিড়ে। মাটির উনুনে কাঠকয়লায় মুরগী-ভেড়া-গোস্ত। ক্যানিং স্ট্রিট, কলুটোলা, রবীন্দ্র সরণী, জাকারিয়া স্ট্রিট, ফিয়ার্স লেন, নাখোদা মসজিদ, তালতলা আর মির্জা গালিব স্ট্রিটের  আনাচ-কানাচে কাবাবের গন্ধ স্থির থাকতে দেয় না।

কলকাতায় কাবাব এসেছিল মুসলিম শাসকদের হেঁশেল থেকে।  তারপর সেটা ‘কলকাতার’ হয়ে উঠতে বিশেষ সময় নেয়নি।  তবে ‘কাবাব’ প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক।  আভিধানিক ভাবে ‘কাবাব’ তুর্কি শব্দ।

পারস্যে দেশে ‘কম’ আর ‘আব’ মানে হল কম জল৷ সেখান থেকেই নাকি কাবাব পদটির উৎপত্তি৷ কারণ কাবাব রান্নায় জল প্রায় দেওয়াই হয় না৷ কাবাব শব্দটির মালিকানা মধ্যপ্রাচ্যের হাতে ছেড়ে দিলেও সংস্কৃত প্রাচীন রন্ধনশৈলীর পুঁথি ‘ক্ষেমকুতূহলম’-এ কাবারের উল্লেখ রয়েছে৷   রামায়ণ মহাভারতেও কাবাবের উল্লেখ আছে। খরগোশ, হরিণ, মহিষের মাংস খোলা খোলা আকাশের নিচে আগুন জ্বেলে পোড়ান হত।

 ‘কাবাব’ মূলত পশ্চিম আর মধ্য এশিয়ার ঐতিহ্য। মরোক্কো থেকে আসা পরিব্রাজক ইবান বতুতার লিখেছেন ১২০০ শতাব্দীতে ভারতে মোগল সম্রাটদের পছন্দের পদ ছিল কাবাব। প্রায় প্রত্যেকদিন মোগল হেঁশেলে নানাবিধ কাবাবের পদ রান্না করতেন আফগান রাঁধুনিরা।

তবে মুঘলদের অনেক আগে আফগানদের হাত ধরে কাবাব ভারতে আসে।  

তুর্কি সৈনিকরা শিকার করা পশুর মাংস তরোয়ালে গেঁথে আগুনে পোড়াত।   মুঘলরা কাবাবে বিভিন্ন রকম ভারতীয় মশলা আর শুকনো ফলের ব্যবহার শুরু করে।

ভারতীয় খাবারের গবেষকরা বলেন, ‘ ট্র্যাডিশনের দিক থেকে যদি বলা যায় তাহলে ভারতে নিরামিষ খাবারের চলই বেশি ছিল এক সময়’। কাবাব গোত্রের খাবার একেবারেই বহিরাগত সেদিক থেকে। তবে পশু শিকার করে মশলা দিয়ে পুড়িয়ে খাবার একটা প্রথা ছিল রাজস্থানে। সেদিক থেকে বলতে গেলে ‘সুলা’ ‘ মানস কা সুলা’ প্রথম ভারতীয় কাবাব। যা তৈরি হত শিকার করা হরিণের মাংস দিয়ে।

পৃথিবীর ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার যেভাবে ঘটেছিল তার সঙ্গে নানা ভাবে বদলে গিয়েছিল খাদ্য সংস্কৃতির ইতিহাসও।

‘কাবাব’ আদতে বহিরাগত হলেও তার ভারতীয়করণ ঘটে।  হরিয়ালি কাবাব, দহি কাবাব, পনির টিক্কা তারই উদাহরণ।

টুন্ড-কি-কাবাব, টিক্কা কাবাব, শামি কাবাব, সুভার কি সাঁথ( শুয়োরের মাংস) একেবারেই ভারতীয় কাবাবের পদ। নিরামিষ কাবাবের উদ্ভাবনও ঘটেছে এখানেই। কাবাবে পনির বা আলুর ব্যবহার পৃথিবীর আর কোথাও বিশেষ দেখা যায় না।

তবে কাবাবের স্টলে যতই নিরামিষ কাবাব তাকিয়ে থাকুক নজর কিন্তু আটকাবে আমিষেই। কাবাবের স্বাদ মিলেমিশে কবে যে পুরোপুরি ভারতীয় হয়ে গিয়েছে তার সন তারিখের খেয়াল কেউ রাখেনি, শুধু খেয়াল থেকেছে জিভে।  

শিক কাবাব, গলৌটি কাবাব, দনীর কাবাব, সুতলি কাবাব, পাত্থর কে কাবাব, শামি কাবা,ককৌরি কাবাব,কালমি কাবাব, রেশমি কাবা্‌ব,বিহারি কাবাব, চাপলি কাবাব এমন হাজার এক নামে ছড়িয়ে পড়েছে কাবাবের মাহাত্ম্য ।  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...