এই গাড়ি ছিল স্টেটাস সিম্বল

কলকাতার শিয়ালদার কাছে রাজাবাজার দিয়ে  যেতে  গেলে   চোখে পড়বে কিছু হাড়জিরজিরে ঘোড়া, তার সহিশ্কুল , খানিক ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে প্রবল আলস্যে  দিনাতিপাতের প্রহর গুনে চলেছে ,   কেউবা আবার   শখের ফিটনকে সাজিয়ে রুজির আশায় প্রস্তুতি নিচ্ছে - কিন্তু তেমন জৌলুস নেই, কেমন যেন প্রবল  বেঁচে থাকার লড়াই।   হালফিলের এই অত্যাধুনিক জীবনের সাথে পাল্লা দিয়ে যেখানে হরেকরকমের গাড়ি রাস্তার দখল নিয়েছে সেখানে তাদের সম্বল ওই রাস্তার পাশটুকুই । বর্তমান পরিস্থিতি তার পথকে আরো সীমাবদ্ধ করে তুলেছে । এখন তার গতি রুদ্ধ হয়েছে  ভিক্টোরিয়ার মুখ থেকে পার্ক স্ট্রিট ময়দান হয়ে এক চক্করে । মূল্য  মাত্র ৫০০ টাকা। যদিও তা নিয়েও ক্রেতাকুলের  দরাদরির  শেষ নেই। কিন্তু  ভাবতে অবাক লাগে  যে এই ঘোড়ার গাড়ি ছিল এক সময়ের স্টেটাস সিম্বল।

শহুরে তিলোত্তমার জন্মলগ্নের  সাথে  ঘোড়ার গাড়ির  সম্পর্ক এক্কেবারে  প্রথম  দিন থেকেই তা বলাই বাহুল্য । পুরোনো কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটলে তা আরো যেন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।ইংরেজদের কলকাতায় আগমনের পর এক গতিময়তা তিলোত্তমাকে স্পর্শ করে।ঘোড়ার গাড়ির  আধিক্য ক্রমবর্ধমান হতে থাকে , তবে অবশ্যই সাহেবদের নিজেদের কাজের জন্য।  যদিও তার আগে কিছু বিত্তশালী মানুষ নিজেদের ব্যক্তিগত   প্রয়োজনেই তার ব্যবহার করতে থাকে। কারণ সময়ের সাশ্রয় এবং জীবনে গতির প্রাবল্য।  তাই পালকি আস্তে আস্তে  ব্যাকফুটে  যেতে  থাকে । যাই হোক  ১৭৭৫ সালে উইলিয়াম জনসন নামের এক  সাহেব কলকাতার পণ্ডিতিয়া অঞ্চলে প্রথম তৈরী করেন  ঘোড়ার গাড়ির কারখানা । ক্রমেই  কলকাতার পরিবেশ বদলে  গিয়ে এক  অদ্ভুত  গতিময়তার স্রোত আসে ফলে  জীবন অনেক দ্রুত হয়ে পড়ে । পাল্লা দিয়ে  ঘোড়ার গাড়ির চাহিদাও বাড়তে থাকে।   ইতিমধ্যেই  বেশ কিছু ঘোড়ার গাড়ি তৈরির কারখানা  তৈরী হয় , যার মধ্যে বিখ্যাত স্টুয়ার্ট অ্যান্ড কোম্পানি  ১৭৮৩-৮৪ সাল নাগাদ ঘোড়ার গাড়ির কারখানাটি তৈরি করেন ওল্ড কোর্ট হাউজ স্ট্রিটে। এরাই  ভারতে প্রথম রেলের যাত্রীবাহী -কোচ  নির্মাণ করে।  কোম্পানির  দায়িত্বে ছিলেন  তিন ভাই- জেসপ, রবার্ট উইলিয়াম।  প্রথম দিকে  কাঠ ছাড়া বাকি সব যন্ত্রাংশই আসত ইংল্যান্ড থেকে। শুধু এদেশে ফিনিশিং করে  গাড়িকে রাস্তায় চলার যোগ্য করে তোলা হত।  কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানিকৃত হওয়ায়  একটু ভালো মানের বাহারি গাড়ির দাম  উঠতো ৩০০ গিনি।  নচেৎ নিম্নমানেরগুলো অবশ্য পঞ্চাশ গিনির হত।  এ সমস্যার সমাধানে প্রচুর এদেশীয় মানুষ ঘোড়ার গাড়ির কারখানায় কাজ নেয়। ইংরেজ  ইঞ্জিনিয়ারের সাহায্যে উৎপন্ন হতে থাকে যন্ত্রাংশ। 

gari

এই সময়ে  ঘোড়ার গাড়ি সে ভাবে  ভাড়া  না  খাটলেও উনিশ শতকের প্রথম দিকে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়ায় খাটতে শুরু করে। এক্ষেত্রে ব্রাউনলো সাহেবের ভূমিকা অনবদ্য। পালকি ও তার বাহকদের হুজ্জুতির নিরসনে তাদের এক্কেবারে ব্যাকফুটে পাঠান এই ব্রাউনলো সাহেব।   আনলেন এক অভিনবত্ব - ১৮২৭ সালে চার চাকার প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে ঘোড়া দিয়ে টানালেন। নতুন গাড়ির নাম হল ব্রাউনবেরি।  যা কিনা সস্তায় পুষ্টিকর। শুরু হলো গাড়ির ভাড়া খাটা। ব্রাউনবেরির  সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে  রাস্তায় ভিড় জমালো  গ্রিনফিল্ড, ব্রুহাম ,ফিটন গিগ ,কেরাঞ্চি চ্যারিয়ট এক্কা টাঙা  - হরেক  প্রকারের  গাড়ি।

কিন্তু ওই যে গতির স্রোত  আর সাচ্ছন্দ্য - তার সাথে যুক্ত হলো  ট্রাম। সময়ের নিরিখে ও প্রয়োজনের তাগিদে  একসময় যেমন   পালকির ঔজ্বল্য ম্লান হয়েছিল তেমনি ম্লান হলো ফিটনের মাহাত্ম্য। যাই হোক ক্রম বর্ধমান গতিশীলতার সাথে পাল্লা দিয়ে আজকের এই প্রগতিশীল তিলোত্তমার আধুনিক রূপ যেখানে সেই ঐতিহ্যিতিবাহী ও ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বাহী ট্রামের হৃদস্পন্দনও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। । এক সময়ের স্টেটাস সিম্বল আজ এক্কেবারে বদলে নিজেদের বাঁচার রসদ খুঁজে চলেছে। আর  মাঝে মাঝে জানান দিচ্ছে পুরোনো কলকাতার ইতিহাসের কথা।

                   

­­­­­––

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...