নস্ট্যালজিক আশির দশক: পূর্ণগ্ৰাস সূর্যগ্ৰহণ

নস্টালজিক বা নস্টালজিয়া কথাটার মধ্যেই যেন একটা মধুর সুখ জড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গানের লাইন উদ্ধৃত করে এখানে বলা যায় "নিবিড় সুখে মধুর দুখে জড়িত ছিল সেই দিন, দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বিণ"– যা চলে গেছে, যে সময়টা আর কখনো ফিরে আসবে না সেই সময়টার সুখস্মৃতি রোমন্থনই হলো নস্ট্যালজিয়া বা স্মৃতিবিধুরতা। এই নিবন্ধ লিখিয়ের পিতৃপুরুষরা ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে ভারতে চলে এসেছিলেন। আমার ঠাকুরদা আমৃত্যু তার সেই ফেলে আসা দেশের কথা বলতেন। বলতে বলতে তার মুখ/মন এক অবর্ণনীয় সুখ মিশ্রিত দুঃখে ভরে উঠত। তিনি জানতেন যে সেখানে আর কখনো ফিরে যাওয়া হবে না তবুও সেই আপন ভূমির কথা বলে তার আশ্চর্য এক সুখানুভূতি হতো। এই যে স্মৃতিবিধুরতা অথবা স্মৃতি রোমন্থন - এটাই হলো নস্ট্যালজিয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এক অবিস্মরণীয় গানে লিখে গিয়েছিলেন "তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মন রে আমার"...

এবার ফেরা যাক ফেলে আসা বিংশ শতকের আশির দশকের কিছু নস্ট্যালজিক ঘটনায়। প্রথমেই বলে নেওয়া যাক মানুষের কৈশোরকাল হলো জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এই নিবন্ধকার তার সম্পূর্ণ কৈশোরকাল কাটিয়েছে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত। সুতরাং, সেই সময়টা এই লিখিয়ের কাছেও সবথেকে মধুর। আবারো রবীন্দ্রনাথ–"আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল"। যা কিছু ঘটেছিল সেই দশকে অর্থাৎ ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত তার সবকিছুই ভালো এই নিবন্ধকারের কাছে। তবুও তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটি ঘটনা নিয়েই এই সিরিজ " নস্ট্যাললজিক আশির দশক"।

এই নস্ট্যালজিক সিরিজ শুরু হচ্ছে ১৯৮০র ফেব্রুয়ারি মাসে। না না তার ও অন্তত এক মাস আগে থেকে। এতদিন পর্যন্ত সূর্যগ্রহণ মানুষ যা দেখেছেন তা ছিল আংশিক সূর্য গ্রহণ। হঠাৎ করে শোনা গেল এই বছর অর্থাৎ ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হবে কিনা পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। স্কুল, কলেজ, অফিস, পাড়া, এলাকা, শহর - সব জায়গায় আলোচনার বিষয়বস্তু একটাই– "পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ"। এখানে বলে রাখা ভালো, গত শতকের কোন মানুষই ১৯৮০র আগে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখেননি। কারণ ভারতবর্ষ থেকে এই প্রথমবার পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে ১৯৮০ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি। চারিদিকে একটা হইচই পড়ে গেল। সেই সময় এতগুলো টিভি চ্যানেলও ছিল না ইন্টারনেট ছিল না। সুতরাং পূর্ণগ্রাস গ্রহণ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ছিল অতি সীমিত। কেউই জানে না সেদিন ঠিক কি ঘটনা ঘটতে চলেছে। সব স্কুলে কলেজে এই মহাজাগতিক ঘটনা নিয়ে আলোচনা হতে শুরু করল কিন্তু কোন স্কুলের মাস্টারমশাই বা দিদিমণিরা কিন্তু এই গ্রহণ দেখার জন্য কোন ছাত্রছাত্রীকে উৎসাহিত করলেন না কারণ তাদের কাছেও এই ঘটনা একেবারে নতুন। এর ফলাফল যে কী হবে তা সম্পর্কে কেউই বিশেষ ভালোভাবে অবগত নন।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে সেই দিন ছুটি ঘোষণা করা হলো এবং বারে বারে খবরের কাগজ মারফত মানুষকে বলা হলো যে সবাই যেন গ্রহণের সময় ঘরের ভিতরে থাকেন। এমনকি পরোক্ষে এও জানানো হলো যাতে দরজা জানালা বন্ধ করেই রাখা হয়। সাধারণ মানুষেরা ভীত এবং বিহ্বল হয়ে পড়ল। অনেকেই ভাবতে লাগলো বা গুজব ছড়িয়ে পড়তে লাগলো যে সেই দিন পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে। মানুষজন যাতে ঘরে থাকেন সেই জন্য দূরদর্শন সেদিন অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা সম্প্রচার করেছিল। এর কারণ কয়েকজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছাড়া কেউই খুব ভালোভাবে এটার বিষয়ে কিছুই জানতো না বলা চলে। মনে রাখতে হবে সেই সময়ে কিন্তু অনেক মানুষের মনে গ্রহণ নিয়ে প্রবল কুসংস্কার ছিল। এখন যেমন টিভি দেখে বা ইন্টারনেট থেকে জেনে আমরা বুঝতে শিখেছি যে এটা একটা মহাজাগতিক ঘটনা। নিজের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে চাঁদ যখন সূর্য এবং পৃথিবীর মাঝখানে চলে আসে তখন সূর্যগ্রহণ হয়। কিন্তু সেই সময়ে বিশেষ করে মহিলারা এতকিছু জানতেন না। এবং তাদের মনে অনেক রকম সংস্কার ছিল গ্রহণ নিয়ে। যেমন গ্রহণ চলাকালীন কোন কিছু খাওয়া যাবে না, রান্না করা যাবে না এবং অন্তঃসত্ত্বা মহিলারা গ্রহণের সময় কিছুতেই ঘরের বাইরে বেরোতে পারবেন না। আমরাও সকলেই জানলাম বা শুনলাম যে সেদিন দুপুরবেলাতেই নাকি রাতের মত অন্ধকার নেমে আসবে। ১৬ ই ফেব্রুয়ারি কয়েকদিন আগে থেকেই কাগজে এই নিয়ে নানা প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখা হতে শুরু করল। মানুষকে বারবার সচেতন করা হলো যেন ওই সময়ের ঘরের মধ্যেই তারা থাকেন এবং বাইরে বেরিয়ে কিছুতেই যেন সূর্য গ্রহণ না দেখেন খালি চোখে।

দেখতে দেখতে চলে এলো ১৬ ই ফেব্রুয়ারি। সব মানুষের মধ্যেই একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। সবার বাড়িতেই একটা "কী হয় কী হয়" ভাব। দুপুর ১২ঃ০০ টার মধ্যে রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে গেল। গ্রহণের পরে এক ব্যক্তি্য সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল যে ওই সময়টাতে বেরিয়ে দিল্লি স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে স্টেশনে একটিও লোক ছিল না। এবং তিনি যে ট্রেনে উঠেছিলেন সেই কামরায় তিনি ছাড়া মাত্র আর একজন মানুষ ছিল। সেই মানুষটিও তাকে সতর্ক করে বলেছিলেন জানালা বন্ধ করে দিতে এবং জানালার ধারে কাছে না বসতে।

তারপর তো বেলা ১টা বাজলো। আস্তে আস্তে সূর্যের আলো কমতে শুরু করল। পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ শোনা যেতে লাগলো। এই নিবন্ধকারের মনে আছে তার একটি পুতুলের ঘর ছিল সেখানে সে পুতুলদের ঘুম পাড়িয়ে তাদের বলেছিল "জানি না রে কাল তোদের কী হবে। আজ যদি মরেই যাই তাহলে কাল তোদের কে ঘুম থেকে উঠিয়ে স্নান করিয়ে দেবে খাইয়ে দেবে বল?" আর যদি স্কুলে না যাওয়া হয় তাহলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার, গল্প করার, টিফিন ভাগ করে খাওয়ার কি হবে এ কথা ভেবে মেয়েটার ভারী মন খারাপ হতে শুরু করল।

দুপুরের রোদ আরো একটু কমে গেল। সবাই তাড়াতাড়ি দুপুরের খাওয়া শেষ করে ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল যেন এক মহা সর্বনাশ হতে চলেছে। দুপুর দুটো নাগাদ হঠাৎ পাখিগুলো সব কিচিরমিচির করে তাদের বাসায় ফিরে যেতে শুরু করল। বাড়ি জানালা সব বন্ধ করে রাখা। তবুও একটা জানালার ফাঁক দিয়ে একটুখানি দেখা গেল যে বাইরে মনে হচ্ছে দুপুরবেলায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সবার বুক দুরু দুরু; সত্যিই কি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে? কেউ সেদিন বিছানায় শোয়নি দুপুরে। কারুর মুখে কোন শব্দ নেই।  ঠাকুরদা ঠাকুমা একমনে ইষ্টনাম জপ করছেন। মা শাঁখ বাজাতে শুরু করেছেন। বাথরুম যাওয়ার নাম করে মা'র অনুমতি নিয়ে দরজা খুলে এই নিবন্ধকার (সেদিনের দশ বছরের মেয়েটা) একটুখানি বেরোলো। খুব কৌতূহলে মা'র পই পই বারণ না শুনে একবার আকাশের দিকে তাকিয়েই ফেলল। তাকিয়েই অবাক; সূর্যটা ওরকম কালো হয়ে গেছে কেন! আর কই পুরো তো অন্ধকার রাত হয়ে যায়নি।

কয়েক মুহূর্ত পরেই আবার আলো ফিরে এলো আকাশে; সারা পৃথিবীতে, সারাদেশে, আমার শহরে ছড়িয়ে পড়ল সেই আলো। পাখিরা আবার দিনের আলো ফুটে ওঠায় মহা গন্ডগোল করে কলরব করতে শুরু করে দিল। গ্রহণ শেষ হওয়া মাত্র বাড়ির/পাড়ার সব লোকজন বাইরে বেরিয়ে পড়ল। সবার মুখে হাসি, সবাই হইচই করতে শুরু করলো যেন একটা মহাবিপদ কাটিয়ে জীবনে ফিরে এল সবাই। সেই রাত্রে অনেক বাড়িতে বা অনেক পাড়ায় মাংস ভাতের পিকনিক হয়েছিল।

এরপর আরো দুবার পূর্ণগ্ৰাস সূর্যগ্রহণ হয়েছিল কিন্তু তখন সব মানুষ জেনে গেছে এটি একটি অতি সুন্দর মহাজাগতির ঘটনা। এর পিছনে বিজ্ঞান ছাড়া অন্য কিছুই নেই এবং এমন সুন্দর মহাজাগতিক দৃশ্য চাক্ষুষ করাটাও অতি সৌভাগ্যের এবং আনন্দের ব্যাপার। এই নিবন্ধকার এর পরের দুটো পূর্ণগ্রাস সূর্য গ্রহণই চাক্ষুষ করেছিল এবং অভিভূত হয়ে গেছিল। সত্যজিৎ রায়ের 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' ছবির এই গানটি উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না – "দেখো রে নয়ন মেলে জগতের বাহার"
পাঠক বন্ধুদের সকলকে দীপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়ে এই নিবন্ধ এখানে শেষ করা গেল। পরের পর্বে আবার নতুন কোন নস্ট্যালজিক ঘটনা নিয়ে আসব।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...