নতুন গুড়ে উৎসবের বার্তা

খাই খাই করো কেন, এসো বসো আহারে—   

শীতের পারদ যেই না কমতে শুরু করে,অমনি বাড়তে থাকে বাঙালির জিভের চাহিদা। আর নাকে যখন আসে নতুন গুড়ের গন্ধ,খাই খাই করা সাজে বই কী।খাওয়া দাওয়ায় অবিচ্ছেদ্য উপকরণ হিসাবে জায়গা করে নেয় এই উপকরণটি।শুধু কি এক রকমের?না,রকমারি স্বাদের ও ধরনের গুড় এই সময় প্রকৃতির আর এক অবদান-

১) ঝোলা গুড়

২) ভেলি গুড

৩) চিটে গুড়

৪) নলেন গুড় (খেজুর গুড়)

৫) পাটালী গুড় (জমাট বাঁধা)

নতুন বছরের শুরুতে ঘুরতে যাওয়া,বনভোজন এর মধ্য দিয়ে যে শীতযাপন তা নলেন গুড় ছাড়া একেবারেরই অসম্পূর্ণ।এ যেন মায়ের ঘাট ছাড়া কলকাতা শহর,গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ।মালপোয়া থেকে ক্ষীরপুলি,এমনকি ভোগেও মেশে নলেন গুড়।নবদ্বীপের একাধিক মঠ-মন্দিরে দুপুরের ভোগে বাধ্যতমূলক হয়ে যায় নতুন গুড়ের পায়েস। সেই সঙ্গে খিচুড়ি। তাতে থাকে নতুন ওঠা শীতের সব্জি।

gur-2 (1)

নতুন গুড় এক রকম উৎসবেরই বার্তা বয়ে আনে। সেই সঙ্গে বয়ে আনে স্মৃতির সোয়াদ।নলেন গুড় আসলে এই শহরের জীবনে গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে পড়ে যায় ছেড়ে আসা বাড়ির কথা। আর সেই বাড়ির সঙ্গে মিশে থাকা সব স্মৃতি যেন এই শীতের দিনে ভিড় করে আসে।হিমে ভেজা সেই দেশভাগের স্মৃতি তাই নলেন গুড়ের মিষ্টিতে যোগ করে দেয় নতুন মাত্রা।পুজোর পরে পৌষ-মাঘে একরকম উৎসব হত নতুন গুড়ের পিঠেপুলি দিয়ে। সেই সঙ্গে ছিল আখের গুড় । তা-ও শীতকালে বেশি পাওয়া যায়। আখের গুড় দিয়ে সিদ্ধ পিঠে খাওয়ার স্মৃতি বিশেষ করে গঙ্গা পাড়ের বাঙালির রান্নাঘর এখনও আমোদিত রেখেছে।

 

gur-1

 

পিঠে, পুলি, পাটিসাপটা, মালপোয়াসব মিষ্টান্নতেই প্রচুর খেজুর গুড়ের ব্যবহার করা হয়।যাঁরা রান্না করতে ভালবাসেন, তাঁদের কথা হল, খেজুর গুড় এমনই এক উপাদান, তা নানা খাদ্যদ্রব্যে নানা ভাবে ব্যবহার করা যায়। তরল নলেন গুড় শক্ত পিঠের মধ্যে ভরে দিলেই তা হয়ে যায় অনুপম এক মিষ্টি, যাকে ভেজে বা সিদ্ধ করে পরিবেশন করা যায় অনায়াসে। এমনকী, সাদা খই সাধারণ আখের গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে মুড়কি তৈরি হয়। নদিয়ার বিস্তীর্ণ অংশে খেজুর গুড়ের তৈরি মুড়কির কদর বেশ ভাল।

gur-3

তবে অনেকেরই মতে, খেজুর গুড়ের মিষ্টির মধ্যে সব থেকে কদর বেশি কড়াপাকের সন্দেশেরই। ক্ষীর, কাজু, কিসমিস সহযোগে জয়নগরের মোয়াও বয়সে প্রাচীন হয়েও কদর ধরে রেখেছে। তুলনায় নবীন খেজুর গুড়ের রসগোল্লাখেজুর গুড়ের দেদো মণ্ডা নামে এক ধরনের মিষ্টিও প্রচলিত এই অঞ্চলে।

নতুন গুড়ের জোড়া সন্দেশেরও বেশ ভালই বিক্রি। ভালই চলে বরফির মতো দেখতে কাজু পেস্তা দেওয়া নলেন গুড়ের সন্দেশও। সাদা ময়দার সঙ্গে কালো জিরে ময়ান দিয়ে আঙুলের মতো লম্বা লম্বা গজার কদরও কম নয়। তাতে ছাঁকা তেলে ভেজে নতুন গুড়ের সঙ্গে গাঢ় রসে ডুবিয়ে তৈরি হয় এই সুস্বাদু গজা।

 

gur-4

 

নলেন গুড় ভালোবাসে না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। কিন্তু খেজুরের রস থেকে কীভাবে গুড় তৈরি হয় এমন তথ্য বোধহয় অনেক মানুষই জানেন না। প্রশ্ন হল, খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড়ের নাম নলেন গুড় হল কীভাবে! এর উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এই শব্দের সাথে দ্রাবিড় সভ্যতার যোগ আছে। মনে করা হয়, প্রাচীন দক্ষিণ ভারতে এর ব্যবহার ছিল, কারণ বাংলা-দ্রাবিড় অভিধানে ‘ণরকু’ শব্দের অর্থ হল ছেদন করা বা কাটা। অন্যদিকে মাননীয় হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ অভিধান’ মতে নরুন বা নরশনি মানেও ছেদন করা বা কাটা, এক্ষেত্রে নরুন হল গ্রামের নাপিতের ক্ষৌর অস্ত্র, কিন্তু গ্রামে বসবাসের সুযোগে দেখেছি খেজুর গাছ থেকে রস বের করতে গুড় প্রস্তুতকারীরা প্রথমে দা দিয়ে করে চেঁছে দেয় তারপর নরুনে ফুটো করে ও তার থেকে রস চুঁইয়ে চুঁইয়ে হাঁড়িতে পড়ে। নরুনে ফুটো করে সেখান থেকে একটা বাঁশের ছিলা লাগিয়ে দেওয়া হয় হাঁড়ি পর্যন্ত, এই পদ্ধতিতেও নল দিয়ে রস চুঁইয়ে পড়া থেকে নলেন গুড় নামের উদ্ভব হতে পারে বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে শব্দের অর্থ যাই হোক, সাহিত্য থেকে বিজ্ঞান সর্বত্র নলেন গুড়ের স্তুতি শুনতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানের মতে, নলেন গুড় উচ্চ ক্যালোরি যুক্ত খাবার, অথচ অ্যান্টি-ফ্যাটের উৎস এটি। তাই যুগে যুগে ঘরে ঘরে প্রতিটি শীতে এর চাহিদা প্রচুর।

তবে এখন খাঁটি খেঁজুরে গুড়ের স্বাদ পাওয়া মুশকিল। রাসায়নিক আর ভেজালে সংমিশ্রনে প্রায় বিলুপ্তির পথে আসল খেজুরে গুড়। তাই তো  শীত না আসতেই  বাজারে-বাজারে উঠতে শুরু করেছে খেজুরের গুড়স্বাদ আর মানভেদে এ খেজুরে গুড়ের পরিচিতি নানা নামে। কেউ চেনে পাটালি, কেউ বলে নলেন গুড়; কেউ বা নারকেলি গুড় বা হাজারি গুড় হিসেবে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...