মুহূর্তগুলো এক একটা কম্পোজিশন

মুহূর্তগুলো এক একটা কম্পোজিশন

এক নাটক যা সমস্ত হেরে যাওয়া, ব্যর্থ,অসহায় মানুষের হাসি কান্নার স্তোত্র।কঠিন জীবনকে তুড়ি মেরে আরও ভীষণ লড়াইয়ের সম্মুখীন হওয়ার আহ্বান জানায়।

কথাকৃতি, ৩০ বছর অতিক্রান্ত করা শহরের প্রথম সারির একটি নাট্যদল। সম্প্রতি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত নাট্যমেলায়, গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি চুঁচুড়া রবীন্দ্রভবনে নয়ন কবিরের পালা নাট্যের আমন্ত্রিত অভিনয় অনুষ্ঠিত হল।দর্শকদের উচ্ছসিত প্রসংসায় দল এখন উৎসব মুখরিত।

নয়ন আর কবির-এই দুই ভাঁড় এই নাটকের প্রান,অর্থাৎ চরিত্র।আরও দুই একজন নাটক জুড়ে আসা যাওয়া করলেও সেটা প্রয়োজনীয় ছিল নাটকের চলনের স্বার্থে।মঞ্চপোকরণ এবং সজ্জা খুবই পরিমিত এবং তার প্রয়োগও হয়েছে যথার্থ।

আসা যাক গল্পে ।পর্দা খোলে আবহে অখিলবন্ধু ঘোষের ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা গান দিয়ে।দর্শকের সামনে আসেন প্রথম চরিত্র ধর্মদাস কবির এবং আরও একটু পরেই দ্বিতিয় জন অর্থাৎ নয়ন চাঁদ প্রামাণিক।তাদের প্রাথমিক কথাবার্তায় বোঝা যায় যে ওই মঞ্চে খানিক আগেই একটি নাটকের অভিনয় শেষ হয়েছে।যেখানে ব্যবহৃত জিনিসপত্রই এদিক ওদিকে ছড়িয়ে রয়েছে।সেই নাটকের পটভূমি ছিল একটি সার্কাসের আদলে ।আর এরা ছিল দুই ক্লাউনের চরিত্রে

nayan-3

এদের কাজ এখন সেই পড়ে থাকা মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া।আর যে গাড়িটি তাদের রোজ নিয়ে যায়,সেদিন কোনো একটা কারণে সেই গাড়িও  এসে পৌঁছয়নি।কী করবে ভাবতে গিয়ে কল্পনার রথে চেপে,ফাঁকা দর্শকাসনে দর্শক দের উষ্ণ উপস্থিতি কল্পনা করে দুই ‘অপটু ’ ভাঁড় পাড়ি দিল নিজেদের অভিনয় প্রতিভা পরখ করার খেলায়।প্রত্যেকবারই একটা করে গল্প খুঁজে আনছে,আর প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হচ্ছে তার সফল মঞ্চায়নে।

অনেক ভাবনা চিন্তার পরীক্ষা দেওয়ার পর নয়ন চাঁদের দেখা একটা অপ্রাসঙ্গিক স্বপ্নকে ভিত্তি করেই তারা এগোলো গল্পের গাড়ি ’।যদিও,শেষমেশ সেই খেলাতেও মিলল হার।অনেক চেষ্টার পরেও একটা ‘সাদামাটা গল্প ’ কে নাটকের রূপ দিতে পারলো না।

nayan-2

ওরা যেন নিজেরাই নিজেদের কাছে হেরে গিয়েছে, বহুদিন আগেই।হয়তো সেই দিন থেকেই যেদিন প্রথম ভাঁড়ের সাজে মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছিল।মঞ্চে থাকা অভিনেতাদের ছায়ায় পড়ে আর আলো নিতে পারেনি নিজেদের মুখে।তাই দর্শকরাও আজ মনে রাখেনি তাদের।ওরা এখন নিজেদের মধ্যেই মাঝে সাঝে শ্রেষ্ঠত্তের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় আর দুজনেই যেতে।কারণ হেরে যেতে যেতে হারাবার তো আর কিছুই অবশেষ নেই।

একটা গাড়ি যেটা রোজ তাদেরকে নিয়ে যায় অন্যান্য মালপত্রের ভিড়ে,সেটা একটা সময় এসে হাজির হয়।আবহে শোনা যায় ‘হর্নে ’র শব্দ।সেই শব্দই যেন নীরবে বলে দেয় তাদের ব্যর্থতার কথা,আরও একবার। আর কতক্ষন! এবার তো যাওয়ার পালা। তাড়াতাড়ি করতে হবে, সময় নেই।ওদের না আছে সামাজিক স্বীকৃতি,না ভালবাসা,না সংসার আর না কোনো পিছুটান।মাঝে মধ্যে নিজের ভিতর থেকেই কোনো একজন কল্পনার ‘রমলা’ বা ‘মনিদীপা’ কে তুলে এনে তাকে চিঠিতে প্রেম নিবেদন জানায়। আবার উত্তরও করে নিজেরাই।একটা অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় তাদের জীবন ঘেরা রয়েছে।

নয়ন এবং কবিরের চরিত্রে দেবরাজ ভট্টাচার্যপ্রসেনজিত বর্ধন বর্ণনারও অতীত।নাটকের দুই চরিত্র নাট্যে অভাবনীয়রূপে মূর্তমাণ।সামঞ্জস্যপূর্ণ পোশাক পরিকল্পনা করেছেন হিমি শর্মা এবং পূজা দত্ত বণিক।রূপসজ্জায় মহঃ ইস্রাফিল এর জাদু হস্তে দুই ভাঁড়ের চরিত্র প্রকৃত রূপ পেয়েছিল।দেবরাজ এর আবহ পরিকল্পনা আর অভীক এবং অনীক চক্রবর্তী দ্বয়ের যথার্থ সঞ্চালনাও নাটকের নিঃশ্বাস।

nayan-1

নির্দেশক সঞ্জীব রায়ের মঞ্চ প্রকল্পনা কে বাস্তব রূপ দিয়েছেন মদন হালদার।বিভিন্ন সময় যারা মঞ্চে আসেন তারা হলেন দলেরই সদস্য, যথাক্রমে মিঠুন গুপ্ত,সৌরভ চট্টোপাধ্যায়বাপি সরকার।নাট্যে আলোক পরিকল্পনা এবং সঞ্চালনার ভার প্রকৃষ্টরূপে সম্পন্ন করেছেন সাধন পাড়ুই এবং তা সদস্যেরা । নেপথ্য পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন দলের অন্যান্য সদস্য, দেবাশিস নস্কর, সত্য রঞ্জন হালদার এবং লাবনী সরকার

নির্দেশক সঞ্জীব রায় -কে কুর্নিশ ও বাহবা এই নাটকের পুনঃস্থাপনের জন্য।নাটকের এবং নাট্য জগতের বরাবরের একটা সামাজিক দায় বর্তায় তাকে ঘিরে যে অগুনতি সাধারন মানুষ, তাদের না বলতে পারা কথা,অক্ষমতা কে স্বীকৃতি দিয়ে সকলকে এক সূত্রে বাঁধা-শ্রী রায়  সেই দায়িত্বের প্রতি চির নিবন্ধ।চলতি নাট্য রীতির বিপরীতে হেঁটে,অনেক আর্থিক দায় মাথায় নিয়ে তিনি ও তাঁর কথাকৃতি আগামী দিনেও মাথা উঁচু করে পথ এগোবেন,এই স্বপ্নই তিনি দেখেন।

এই নাটকের প্রথম আত্মপ্রকাশ আজ থেকে প্রায় পাঁচ দশক আগে।শ্যামল ঘোষের  নির্দেশনায় নক্ষত্র এই নাট্যের প্রথম সফল মঞ্চায়ন করেছিল। অভিনয়ে ছিলেন দুই পুরোধা, যথাক্রমে শ্যামল ঘোষ ও শ্যামল বরণ ঘোষ।পরে অবশ্য বাদল সরকার-ও কিছু অভিনয়ে সঙ্গত দেন।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...