কালী কথা: নানেদের কালী মন্দির

কলকাতায় এসে ইউরোপীয়রা যেসব অঞ্চলে ঘনজনবসতি গড়ে তুলেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল হেদুয়া অর্থাৎ আজকের গিরিশ পার্ক। এই অঞ্চল থেকে শুরু হয়েছিল আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের কাজ। এই অঞ্চলেই একজন নান গড়ে তুলেছিলেন কালী মন্দির। সে মন্দির আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কালী নগরী কলকাতার জাগ্রত কালী মন্দিরদের মধ্যে অন্যতম নানেদের কালী মন্দির। হেদুয়া পার্কের কাছে মন্দিরটি অবস্থিত। ঠিকানা ২৫, বেথুন রো, হেদুয়া। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। নবরত্ন শৈলীতে নির্মিত অর্থাৎ নয় চূড়া বিশিষ্ট। ১২৭২ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮৬৫ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন ঈশ্বরচন্দ্র নান। মন্দিরে প্রতিষ্ঠাফলকে রয়েছে - "শ্রীশ্রীনিস্তারিণী জয়তি/ কালীকে চরম কালে তব রাঙ্গা পায়/ ঈশ্বরের মনঃপ্রাণ সকলী মিশায়/ শকাব্দা ১৭৮৭/ সন ১২৭২ সাল"

 

ঈশ্বরচন্দ্র গড়ে ১৮৬৫ সালে রথযাত্রার দিন এই মন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থাৎ মন্দিরের বয়স প্রায় একশো ষাট বছর। ব্যবসায়ী রামসুন্দর নানের পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র নান পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিকারিক হয়েছিলেন। এই মন্দির প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। নানেদের পড়শী ছিলেন কৃষ্ণমোহন সিংহ। তিনিও ছিলেন বিত্তবান মানুষ। একদা কৃষ্ণমোহন ভেবেছিলেন তিনি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই উদ্দেশে বারাণসীতে কালো কষ্টি পাথরের মূর্তি নির্মাণের বরাত দেন। দক্ষিণাকালীর মূর্তি গড়াচ্ছিলেন তিনি। নির্মাণের পর সেই মূর্তি বারাণসী থেকে জলপথে নৌকো করে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেয়। কলকাতার আহিরীটোলা ঘাটে যেদিন দেবীর প্রস্তর মূর্তি এসে পৌঁছল, সেই দিনই কৃষ্ণমোহনের পরিবারের কোনও সদস্যের মৃত্যু ঘটে। ওই ঘটনায় মন্দির প্রতিষ্ঠার ভাবনা থেকে সরে আসেন কৃষ্ণমোহন।

 

এরপর কৃষ্ণমোহন প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্রেরা পড়লেন চিন্তায়। কী করবেন মূর্তি নিয়ে?

দেবতার বিগ্রহ, পুজো না করলে যদি ক্ষতি হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে যদি আবার বাড়িতে মৃত্যু ঘটে। তাঁরা ঈশ্বরচন্দ্র নানের শরণাপন্ন হলেন। ঈশ্বরচন্দ্রকে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন ওই কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। ঈশ্বরচন্দ্র নান ছিলেন ধনী মানুষ। প্রভুত টাকা করেছিলেন। তাঁর পক্ষে মন্দির গড়া কষ্ট সাধ্য কাজ নয়। তিনি ধর্মভীরুও ছিলেন। দুর্গাপুজো করতেন। ১৮৬৩ নাগাদ নিজের জমিতে মন্দির নির্মাণ আরম্ভ করলেন তিনি। ১৮৬৫ সালে রথযাত্রার দিন দক্ষিণাকালীর মূর্তিকে দেবী নিস্তারিণী হিসাবে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। সেই থেকে রথযাত্রার দিনটি নিস্তারিণী কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে মহাসমারোহে পালন করা হয়। ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরিরা মন্দিরের দেখভাল করেন। মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ, দেবসেবা ও পুজো জন্য ঈশ্বরচন্দ্র দেবত্র ট্রাস্ট গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। 

 

এই মন্দিরের দেবী কালিকা নিস্তারিণী দেবী বা ইচ্ছাময়ী কালী নামে পরিচিতা। দেবী শাক্ত হলেও পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। গর্ভগৃহে প্রস্তর মূর্তিতে বিরাজ করেন তিনি। এখানে দেবী কালীর নিত্যপুজো হয়। প্রতি অমাবস্যায় দেবীর পুজো হয়। যজ্ঞের আয়োজন করা হয়। দীপান্বিতা কালী পুজোর দিন বিশেষ পূজা হয়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে অর্থাৎ রথযাত্রায় বিশেষ পুজো হয়। তাই এই মন্দিরে পশুবলি বন্ধ। মন্দিরে রয়েছে নারায়ণের ঘর এবং দুর্গা দালান। কালী মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে থেকে নান পরিবার পালা করে দেবী দুর্গার আরাধনা করত। আজও সেই রীতি মেনে বাড়ির দুর্গা দালানে দেবী দুর্গার পুজো হয়। মন্দিরের সামনে দুই পাশে দুটি আটচালা শিব মন্দিরে আছে, সেখানে দুটি কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। পিঠরক্ষক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে ভুবনেশ্বর শিব। মন্দিরে দেবী নিস্তারিণীর পাশাপাশি শিবলিঙ্গেরও নিত্যপুজো হয়। 

 

এই প্রসঙ্গে এসে পড়ে, কলকাতার আরও এক কালী মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বারাণসী। সেটিও গিরিশ পার্ক অঞ্চলেই অবস্থিত। বারাণসী কালী মন্দির, যা কাশী রাজ কালী মন্দির নামেও পরিচিত। মন্দিরটি ১৯৪৩ সালে মহারাজা কাশী রাজা প্রভু নারায়ণের মা তৈরি করেছিলেন। বারাণসী থেকে আনা কষ্টিপাথরের মূর্তি এখানে প্রতিষ্ঠিত। আর একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, নদীয়ার রাজা গিরীশ চন্দ্র রায় ১৮২৫ সালে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...