নদীয়া হাউস: কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের ইতিহাসে এক বনেদি অধ্যায়

নিজেকে গর্ব করে কৃষ্ণনাগরিক বলতেন প্রমথ চৌধুরী। কৃষ্ণনগরের সঙ্গে তাঁর র যোগাযোগের কারণেই নিজেকে এমন নামে ডাকতেন। প্রমথ চৌধুরী থাকতেন বালিগঞ্জে, দু'নম্বর ব্রাইট স্ট্রিটের বাড়িতে। ১৯২০ সালে কৃষ্ণনগরের মহারাজা ক্ষৌনীশ চন্দ্র রায় এই বাড়িটি কিনে নেন প্রমথ চৌধুরীর স্ত্রী সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন ইন্দিরা দেবীর কাছ থেকে। কৃষ্ণনগরে প্রমথ চৌধুরীর বাড়িতে কিনে নিয়েছিলেন কৃষ্ণনগরের মহারাজা পরিবার। নদিয়া হাউস বাড়িটির ইতিহাসের সঙ্গে এমন অনেক হাত বদরের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। দু'নম্বর ব্রাইট স্ট্রিটের বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কলকাতার বনেদিয়ানার ইতিহাস। ব্রাইট স্ট্রিটের আগে নাম ছিল ঘুঘুডাঙা রোড। তারও আগে গুপিডাঙা লেন। ব্রাইট স্ট্রিটের নাম যখন হয়েছে তখন আদি কলকাতার পঞ্চান্নগ্রামের অন্যতম একটি গ্রাম বা পাড়া হিসেবে ওই অঞ্চলকে চেনার আর উপায় ছিল না। ১৯০০ সালে ১লা সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়ান চার্চ এর রেভারেন্ড টমাস ম‍্যালকম এবং তাঁর স্ত্রী দু'নম্বর ঘুঘুডাঙ্গা রোডের নয় বিঘা পাঁচ কাঠা দশ ছটাক জমিন তাঁদের বসতবাড়িটি বন্দক দেন ভারতের প্রথম আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। ওই তারিখে একটি দলিলও তৈরি করা হয়। এদিকে ম্যালকম সাহেব বাড়িটি আর ছাড়িয়ে নিতে পারেননি।

সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিক্রি করে দেন বাড়িটি। বাড়ির মালিকানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় তাঁর নাম। এই বাড়ি আসলে বহুবার হাতবদল হয়েছে। ১৮৬৮ সালের আগে এক সাহেব কলিনস এই অঞ্চলের জমিতে বাড়ি তুলেছিলেন। ওই বছর জুলাই মাসে কলিনস ও তাঁর স্ত্রী মার্গারেট জমি ও বসতবাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন আরেক ব্রিটিশ সাহেবকে। বাড়িটির প্রথম নাম ছিল মেরি ভিল । ম‍্যালকম তার নাম বদলে রেখেছিলেন গুড হোপ ভিলা। এই বাড়ি ম‍্যালকম যে আশাতেই তৈরি করে থাকুক না কেন বেশিদিন বাড়িটি তাঁর হাতে ছিল না। তিনি এটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এরপর বাড়িটি আসে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। তখন বাড়িটির নাম হয় কমলালয়। ১৯৬০ সালের ৭ ই ডিসেম্বর সুরেন্দ্রনাথ ও তার পিতা সত্যেন্দ্রনাথ বাড়িটি উপহার দেন ইন্দিরা দেবীকে। কৃষ্ণনগর রাজ পরিবার কেনার পর দু'নম্বর ব্রাইট স্ট্রিটের বাড়ির নাম বদলে হয় নদীয়া হাউস।।

মহারাজা ক্ষৌনীশ চন্দ্র এই বাড়িটি কিনেছিলেন চার বিঘা জমি সঙ্গে নিয়ে। এই বাড়ির উত্তরে ব্যারিস্টার অমিয়নাথ চৌধুরী বাড়ি। বর্তমানে এটিই ডাবলু সি ইনস্টিটিউট হিসেবে পরিচিত।

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে কৃষ্ণনগর রাজ পরিবারের বাড়ি ছিল কালীঘাট অঞ্চলে। কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সদর দপ্তর হওয়ার পর কলকাতা সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বেড়ে যায়। কালীঘাটের পর তাঁদের বাড়ি হয় মানিকতলায়। সেখান থেকে ১১২ নম্বর রিপন স্ট্রিটে। পরে এই বাড়িটি বিক্রি করে দেন ক্ষৌনীশ চন্দ্র।

অল্প বয়সেই মারা যান এই রাজা। শান্তিপুর থেকে তিনি এম এল সি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজিস্ট দলের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ যোগাযোগ ছিল। দু'নম্বর ব্রাইট স্ট্রিটের বাড়িতে আসতেন বাংলার বিশিষ্ট সব রাজনৈতিক নেতা ও সমাজকর্মীরা। নদীয়া হাউসের বাড়ির মালিক নিজে ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর অন্তরঙ্গ শিল্পীরাও বহুবার এই বাড়িতে এসেছেন। একতলা বাড়ি। বেসমেন্ট থেকে বারো ধাপ সিঁড়ি ভেঙে একতলায় যেতে হয়। ক্ষৌনিশ চন্দ্র বাড়ির পেছনের দিকে দোতলা বাড়িয়ে তুলেছিলেন। বাড়িটি তিনি আর করে যেতে পারেননি। এই বাড়িটি শেষ করেছিলেন মহারানী জ্যোতির্ময়ী দেবী। ক্ষৌনীশ চন্দ্রের ছেলে সৌরিশচন্দ্র রায় প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। বিখ্যাত ছিল তাঁর লাইব্রেরী। আদি টাইম স্কোয়ারের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কত ছিল, লালবাজারের জেলের চেহারাই বা কেমন ছিল এসব তথ্য তাঁর হাতের মুঠোয় ছিল।

কৃষ্ণনগরের রাজ পরিবারের জন্যই বাংলা সাহিত্য পেয়েছে বীরবলকে। এই বাড়ি আরো জানায় গোপাল ভান্ডারীর কথা অর্থাৎ গোপাল ভাঁড়ের কথা। কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের রাজত্ব বা জমিদারি এখন আর সেভাবে নেই। তবুও এই নদিয়া হাউস ইতিহাসের বুকে এক অনন্য নজির রেখে গেছে ।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...