অক্ষয় তৃতীয়া: মহাভারত রচনা থেকে গঙ্গার মর্ত্যে আগমন, সবই ঘটেছিল এই তিথিতে

আজ অক্ষয় তৃতীয়া। এই দিনটিকে হালখাতার মতো পালন করেন ব্যবসায়ীরা। লক্ষ্মী, গণেশের পুজো করা হয়। মিষ্টি মুখ চলে। বিভিন্ন শুভ কাজ করা হয়। দেবপ্রতিষ্ঠা, বিবাহ, গৃহপ্রবেশ, সম্পত্তি ক্রয়, গৃহনির্মাণ, পিতৃপুরুষের পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম ও তর্পণ প্রভৃতি নানা ধরনের শুভ কাজের ক্ষেত্রে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটির কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু এদিনের পৌরাণিক মাহাত্ম অপরিসীম। মনে করা হয়, এই তিথিতেই ত্রেতা যুগ শেষ হয়ে, দ্বাপর যুগ শুরু হয়েছিল। এই দিনেই তপস্যার করে গঙ্গাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিলেন ভগীরথ। কৃষিপ্রধান দেশ ভারতে অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিতে ধরিত্রীদেবীর পুজো করা হয়। অক্ষয় তৃতীয়া তিথিটিকে পরশুরাম জয়ন্তী হিসেবে পালন করা হয়। মনে করা হয়, বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম এদিনেই জন্মেছিলেন। ঋষি জমদগ্নি ও রেণুকার পুত্র পরশুরাম ব্রাহ্মণ হলেও, আচরণে ছিলেন বীর ক্ষত্রিয়ের মতো। ব্রহ্মক্ষত্রিয় পরশুরামের দেশের বিস্তৃর্ণ অংশে রাজত্ব করতেন। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পরশুরাম পৃথিবীকে ২১বার ক্ষত্রিশূন্য করেছিলেন। 

অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেই মহর্ষি কৃষ্ণদৈপায়ণ বেদব্যাসের মুখনিঃসৃত বাণী মহাভারত আকারে লিপিবদ্ধ করতে আরম্ভ করেন গণেশ। মহাভারত হল মহাকাব্য, যা পঞ্চম বেদ হিসেবে স্বীকৃত। আদপে মহাভারতের দ্বৈরথের শুরু এদিন থেকেই, ভাইয়ে-ভাইয়ে বিরোধ বহুদিন ধরেই ছিল। শেষ আগুন জ্বলেছিল এদিন। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন হস্তিনাপুরের রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টা করেছিলেন দুঃশাসন। দ্রৌপদীর প্রার্থনায় শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বস্ত্র দান করেছিলেন। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন বৈভবলক্ষ্মীর পুজো হয়। কুবেরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব এই তিথিতেই তাঁকে অসীম ধন ও ঐশ্বর্য প্রদান করেন। তাই মনে করা হয়, এই দিন কিছু প্রার্থনা করলে তা অক্ষয় হয়। আর তিথিটি যেহেতু তৃতীয়, তাই দুয়ে মিলে অক্ষয় তৃতীয়া। অক্ষয় শব্দের অর্থ যার কোনও ক্ষয় নেই। এই তৃতীয়া তিথি ক্ষয়হীন। অর্থাৎ যার ফল কখনও নষ্ট হয় না। অক্ষয় তৃতীয়াতেই পুরীতে জগন্নাথের রথযাত্রার রথ নির্মাণ শুরু হয়।

অক্ষয় তৃতীয়াকে কেন্দ্র করে, বিষ্যপুরাণে এক অহংকারী ব্রাহ্মণের কাহিনী রয়েছে। ব্রাহ্মণ অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির, সে কাউকেই কোনওভাবে সাহায্য করে না। একদিন ক্ষুদা ও পিপাসায় কাতর এক ব্যক্তি ব্রাহ্মণের কাছে জল চাইলে, ব্রাহ্মণ তার সামনেই দরজা বন্ধ করে দেন। তারপর বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে বলেন, তাঁর ঘরে খাবার, জল নেই। ব্রাহ্মণপত্নী দয়াবতী স্বামীর নিষেধ অমান্য করে ওই ব্যক্তিটিকে অন্ন ও জলদান করেছিলেন। মৃত্যুর পর যমলোকে ব্রাহ্মণের বিদেহী আত্মার ঠাঁই হয়। অন্ন-জল বিনা নিদারুণ কষ্টে ছিল আত্মা। পত্নীর পুণ্যকর্মে একসময় যমলোক থেকে মুক্তি পায় আত্মা। ব্রাহ্মণ পুনর্জন্মলাভ করে। নতুন জন্মে অক্ষয় তৃতীয়ার ব্রত পালন করে যশস্বী হন ব্রাহ্মণ। মনে করা হয় সত্যযুগের শুরু অক্ষয় তৃতীয়ায়। অক্ষয় তৃতীয়ায় কৃষ্ণর বাল্যসখা সুদামা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে বৃন্দাবন থেকে দ্বারকায় এসেছিলেন। প্রিয়তম বন্ধুর জন্য সে কাপড়ের পুটুলিতে তিনমুঠো তণ্ডুল বেঁধে এনেছিল। তা পরম তৃপ্তিতে গ্রহণ করেন কৃষ্ণ। সুদামা নিজের দারিদ্রের কথা বলতে পারলেন না। কৃষ্ণের অজানা কিছুই নয়। সুদামা ফিরে এলেন বৃন্দাবনে। তাঁর পর্ণকুটির হয়ে উঠল এক সুরম্য বাসগৃহ। সেখানে রয়েছেন স্ত্রী বসুন্ধরা ও সন্তানরা। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, অক্ষয় তৃতীয়ার দিনটিতেই সুদামার দারিদ্র‌ দুঃখ মোচন করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, শ্রীকৃষ্ণের কাছে অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য জানতে চেয়েছিলেন রাজা যুধিষ্ঠির। উত্তরে কৃষ্ণ বলেছিলেন, অক্ষয় তৃতীয়ার মাহাত্ম্য অনন্ত। সূর্য বনবাসের সময় যুধিষ্ঠিরকে অক্ষয় পাত্র দান করেছিলেন। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, এদিন ভগবান নরনারায়ণ, শ্রীশ্রী হয়গ্রীব মাধব, শ্রীশ্রীধূমাবতীদেবী এবং শ্রীশ্রীপরশুরামের আবির্ভাব হয়েছিল। এদিন শ্রীশ্রীপরশুরাম ও দশমহাবিদ্যার অন্যতম শ্রীশ্রীধূমাবতীদেবীর পুজো অনেকেই করেন। এদিন শিব, গঙ্গা, কৈলাস, হিমালয় ও ভগীরথের পুজোও হয়।

অক্ষয় তৃতীয়ায় পুরীধামে জগন্নাথদেবের ২১ দিনব্যাপী চন্দনযাত্রার শুরু। জগন্নাথদেবের রথনির্মাণ শুরু হয় এদিন। যা আষাঢ়ের শুক্ল দ্বিতীয়ার আগে অর্থাৎ রথযাত্রার একদিন আগে শেষ হয়। পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির থেকে জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার তিনটি আজ্ঞামাল্য বহন করে আনেন তিনজন পান্ডা। রথ নির্মাণ শুরু হোক, জগন্নাথদেবের নির্দেশ আজ্ঞামালার মাধ্যমে পৌঁছে যায় পুজোস্থলে। যেখানে জগন্নাথদেবের চন্দনযাত্রা এসে থামে, সেখানে রথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এরপর রথ নির্মাণের প্রথম ধাপ শুরু হয়। জগন্নাথ মহাপ্রভু নরেন্দ্র সরোবরে হাওয়া খেতে যান। এই সরোবরে তাঁর চন্দনযাত্রা উৎসব খুব ধুমধাম করে পালিত হয়। জগন্নাথদেবের মূর্তির শ্রীঅঙ্গে চন্দনের প্রলেপ পড়ে। জগন্নাথদেবের নৌকাবিহার দেখতে বহু ভক্তের সমাগম হয় সরোবরের চারদিকে। সরোবরের মাঝে মন্দিরে জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রার উৎসব মূর্তির প্রতিদিন পুজোর্চনা হয়। শ্রীশ্রীরামঠাকুরের তিরোধান অক্ষয় তৃতীয়ায়। এদিন তাঁর বিভিন্ন মঠ ও মন্দিরে তিরোধান স্মরণোৎসব।

কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী; এই চারধাম যাত্রা শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ায়। গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ এবং বদ্রীনাথ মন্দির সেদিনই দরজা খোলে। দরজা খুলে দেখা যায় ছ-মাস আগে যে অক্ষয়দ্বীপ জ্বালিয়ে রেখে আসা হয়েছিল তা তখনও জ্বলছে। মনে করা হয়, এদিনই দেবী অন্নপূর্ণার আবির্ভাব হয়েছিল।

তিথিটির নামকরণের একটি অন্য কিংবদন্তি রয়েছে, পুরাণ অনুযায়ী, মহাভারতে পাণ্ডবরা যখন অজ্ঞাতবাস এবং নির্বাসনের মোট ১৩ বছর কাটিয়ে ফেলেন, তারপর একদিন ঋষি দুর্বাসা, তাঁদের সন্ধানে তাঁদের অস্থায়ী বাসস্থানে প্রবেশ করেন। দ্রৌপদী তাঁকে অক্ষয় পাত্রে আহারাদি খেতে দেন। এই আপ্যায়নে এবং আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে দুর্বাসা বলেন, ‘আজ অক্ষয় তৃতীয়া। আজ যে ছোলার ছাতু, গুড়, ফল, বস্ত্র, জল ও দক্ষিণা দিয়ে বিষ্ণুর পুজো করবে, সে সম্পদশালী হয়ে উঠবে।’মনে করা হয়, এরপর থেকেই অক্ষয় তৃতীয়া জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই দিন পুজো করার রীতি সেই থেকেই চলে আসছে। আজও এইদিনটিতে শুভ কাজ সারেন সকলে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...