চেনা সিলেবাসের বাইরে: মুড়ির অন্য স্বাদের সন্ধানে

আচ্ছা মুড়ি খেতে কে না ভালোবাসে বলুনতো! কিন্তু রসে বশে জমিয়ে কোনওদিন
মুড়ি খেয়েছেন কি? কলকাতা এবং তার আশে পাশের বেশ কিছু জায়গায় চপ মুড়ি
খাওয়ার নিয়ম হল, একমুঠো করে শুকনো মুড়ি মুখে চালান করে দিয়ে একটুকরো চপে
আলতো কামড় দেওয়া। কিন্তু মফঃস্বল অর্থাৎ বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম,
বর্ধমানের মানুষজন এই স্টাইলে মুড়ি খায় না। সেখানে বেশ রাজকীয় ভাবেই মুড়ি
খাওয়া হয়।

পরিমাণ মতো মুড়ি নিয়ে তাতে জবজবে করে সরষের তেল মেখে তার সঙ্গে
বেশ প্রমাণ সাইজের দুখানা চপ, একটা আস্ত কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা - এই
সমস্ত উপকরণ জল দিয়ে এক সঙ্গে জল দিয়ে মেখে তবেই মুড়ি খাওয়া হয়। আহা! কী
অপূর্ব তার স্বাদ। যখন এই মুড়ি মুখে চালান করে দেবেন, তখন মনে হবে
অল্পেতে স্বাদ মেটে না, এ স্বাদের ভাগ হবে না।

Muri1

মফঃস্বলের লোক জল ঢেলে মুড়ি খায় বলে কলকাতাবাসীর সে কী হাসাহাসি! তারা
ভাবে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার লোক মুড়ি ছাড়া বোধ হয় আর কিছুই খেতে জানে না।
যদিও এই সব প্রত্যন্ত জেলা এখন কলকাতার তুলনায় কোনও অংশেই পিছিয়ে নেই।
সেখানেও এখন সুইগি, জমেটোর ছড়াছড়ি। এক ক্লিকেই বাড়িতে এসে যাচ্ছে পিৎজা,
বার্গার, হটডগ। সেখানেও এখন জন্মদিন সেলিব্রেট হয় মিও আমোরের কেক দিয়েই।
কিন্তু সেই সব খাবারে দেশজ শিকড়ের টান নেই। মায়ের হাতের গন্ধ নেই।

রাঢ়বঙ্গের লোকের মুড়ি খাওয়া নিয়ে নিন্দুকরা বেশ অভিনব কুৎসা রটিয়েছিল।
ইন্দিরা গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী। সকাল ন’টা সাড়ে ন’টা নাগাদ তিনি
বাঁকুড়ার ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারে করে যাচ্ছিলেন। সেইসময় একটা ‘সোঁ সোঁ’
আওয়াজ তাঁর কানে আসে। পাশে থাকা এক আধিকারিককে তিনি জিজ্ঞাসা করেন - "এটা
কীসের শব্দ?" সেই আধিকারিক তাঁকে জানান যে এইসময় বাঁকুড়ার লোক মুড়িতে জল
ঢেলেছে।

Muri2

কথায় বলে যস্মিন দেশে যদাচার। বিভিন্ন জেলায় মুড়ি খাওয়ার বিভিন্নরকম প্রথা
রয়েছে। তাছাড়া খাওয়া দাওয়াটা মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেই সব
নিয়ে হাসাহসির কিছু নেই। যেমন কলকাতা বা মেদিনীপুরের অধিকাংশ লোক মুড়িতে
গরম ঘুগনী ঢেলে চামচে করে খায়। তবে রাঢ়বঙ্গের অধিকাংশ বাড়িতে এখনও
পর্যন্ত প্রধান জলখাবার কিন্তু চপ-মুড়ি। এমনকি অত্যন্ত শৌখীন শহুরে
জামাইকেও এই চপ মুড়ি দিয়েই আপ্যায়ণ করা হয়। লুচি তরকারি যে খায় না তা নয়।

কিন্তু মুড়ি খাওয়াটাই সেখানকার ঐতিহ্য। তবে দক্ষিণবঙ্গের মুড়ি কিন্তু
মেশিনে ভাজা কলকাতার মুড়ির মত স্লিম অ্যান্ড ট্রিম নয়। সেখানকার মুড়ি
হাতে ভাজা। বেশ নাদুস নুদুস ফুলফুলো তার চেহারা। অসাধারণ তার টেস্ট। সেই
হাতে ভাজা মুড়ির সঙ্গে অন্য কিছু লাগে না। সামান্য সরষের তেল দিয়ে মাখলেই
হবে। স্বাদে গন্ধে সে মুড়ি অতুলনীয়!

Muri3

শুধু মুড়ি খাওয়া নিয়েই বাঁকুড়ায় আস্ত একটা মেলা হয় নদীর ধারে। নাম
মুড়িমেলা। সে গল্প অন্য একদিন শোনানো যাবে। তবে দক্ষিণ বঙ্গের লোকের মুড়ি
প্রীতির আরও বেশ কিছু তরিবৎ আছে। যেমন পান্তা ভাতের সঙ্গে মুড়ি আর
তেলপোড়া দিয়ে মেখে খাওয়ার কী স্বাদ তা যে না খেয়েছে তাকে বোঝানো অসম্ভব।
শীতকালে বাসি বাঁধাকপির তরকারির সঙ্গে কাঁচালঙ্কা সহযোগে টানটান করে মুড়ি
মেখে খেলে শীতের সকাল জাস্ট জমে যাবে। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সকলের
কাছেই মুড়ি দারুণ প্রিয়।

সকালবেলায় বাড়ির বাইরে বেরোলেই বিভিন্ন দোকানে চপ মুড়ি খাওয়ার ভিড় চোখে
পড়ার মতো। তবে দোকানে যারা খায় তারা সাধারণত কাঁচা শালপাতাকে খোলার মত
করে তাতেই মুড়ি খায়। একই সঙ্গে হাইজিনিক এবং ধোয়ার ঝামেলা থেকে মুক্তি।
মুড়ির সঙ্গে চপ যদি নাও থাকে তাহলে গোটা মুশুর বা রমা সেদ্ধ (বরবটির বীজ)
দিয়ে মুড়ি দারুণ লাগে। কাজেই মুড়ি নিয়ে নাক উঁচু করার কিছু নেই।

যে যার অভিরুচি অনুযায়ী খাবার খেতে পারে। মুড়ি মানেই যে শুধু বাঁকুড়া পুরুলিয়ার
লোকেরাই খায় এমন ভাবনা ঠিক নয়। মুড়ি সর্বোত্তম খাবার। একই সঙ্গে উপকারি
এবং উপাদেয়। তাই এমন একটি উপকারি খাবারকে দূরে সরিয়ে রাখার কোনও মানেই হয়
না। রসে বশে মজে থাকা বাঙালি মুড়ি খাক আরও রসিয়ে, আরও জমিয়ে। চেটেপুটে
উপভোগ করুক জীবনের এই টুকরো টুকরো ভালোলাগাকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...