রবীন্দ্রনাথের ‘মা’

“মাকে আমার পড়ে না মনে। শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে একটা কি সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে, মায়ের কথা মিলায় যেন আমার খেলার মাঝে। মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে - মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে।”

সারদাসুন্দরী দেবী। তাঁর পনেরোটি সন্তানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ চোদ্দতম। কনিষ্ঠ সন্তান বুধেন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াণ ঘটায় রবিই তখন সবচেয়ে ছোট।

মায়ের কাছে তাঁর তেমনভাবে আসা হয়নি। আর পাঁচটা বড় বাড়ির অন্দর মহলে যেমন হয় তেমনি ছিল তাঁর শৈশব। খাওয়া থেকে ঘুম সবই ভৃত্য আর দাসীর হাতে। সেখানে দায়িত্বের দায় আছে, আদরের টান নেই।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ঘরোয়া’-তে রবীন্দ্রনাথের মায়ের কথা পাওয়া যায় কবির নিজের কথায়। ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে কবি বলেছেন, “মাকে আমরা পাইনি কখনো, তিনি থাকতেন তার ঘরে তক্তপোশে বসে, খুড়ির সঙ্গে তাস খেলতেন। আমরা যদি দৈবাৎ গিয়ে পড়তুম সেখানে, চাকররা তাড়াতাড়ি আমাদের সরিয়ে আনতেন যেন আমরা একটা উৎপাত। মা যে কী জিনিস তা জানলুম কই আর। তাইতো তিনি আমার সাহিত্যে স্থান পেলেন না।”

মায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা স্নেহ তিনি পাননি। কিন্তু একেবারে যে কিছু পাননি তা নয়। মাঝখানের যে না পাওয়াটুকু সে তো জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের আভিজাত্যের গরিমা।

যতটুকু পেয়েছেন ততটুকুকেই স্মৃতিকথায়, কলমে গেঁথেছেন কবি। জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘মনে পড়ে বাড়ি-ভিতরের পাঁচিল-ঘেরা ছাদ। মা বসেছেন সন্ধ্যেবেলায় মাদুর পেতে, তার সঙ্গিনীরা চারদিকে ঘিরে গল্প করছে। এই সভায় আমি মাঝে মাঝে টাটকা পুঁথিপড়া বিদ্যের আমদানি করেছি…. পৃথিবীসুদ্ধ লোকে কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়িয়া জীবন কাটায়, আর আমি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির স্বরচিত অনুষ্টুপ ছন্দের রামায়ণ পড়িয়া আসিয়াছি, এই খবরটাতে মাকে সবার চেয়ে বেশি বিচলিত করিতে পারিয়াছিলাম। তিনি অত্যন্ত খুশি হইয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, বাছা, সেই রামায়ণ আমাদের একটু পড়িয়া শোনা দেখি’।
কবির কলম পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায় ‘লুকিচুরির’ লাইনগুলো। সেখানেই কবি এঁকেছেন,

“ দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে
বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে,
গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে
পড়বে এসে তোমার পিঠে কোলে,
আমি আমার ছোট্ট ছায়াখানি
দোলাব তোর বইয়ের ‘পরে আনি—”
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।

কবির তখন চোদ্দ ছুঁই-ছুঁই, মা চলে গেলেন। জীবন থেকে কী হারিয়ে গেল তা বোঝার মতো বোধ তখনও কবির হয়নি। সেই প্রছন্ন বেদানা ফিরে এসেছে পরিনত বয়সে।

প্রিয়জন মৃত্যুর অভিঘাত বারবার নেমে এসেছে কবির জীবনে। বিক্ষত হয়েছেন। আঁকড়ে ধরেছেন শব্দকে। মাকেও সেভাবেই পেয়েছেন কবি। শব্দে গ্রথিত করেছেন মায়ের স্মৃতি।

তিনি লিখেছেন, “আমার একটি স্বপ্নের কথা বলি, আমি নিতান্ত বাল্যকালে মাতৃহীন। আমার বড় বয়সের জীবনে মার অধিষ্ঠান ছিল না। কাল রাত্রে স্বপ্ন দেখলুম, আমি যেন বাল্যকালেই রয়ে গেছি। গঙ্গার ধারের বাগান বাড়িতে মা একটি ঘরে বসে রয়েছেন। মা আছেন তো আছেন।

তার আবির্ভাব তো সকল সময়ে চেতনাকে অধিকার করে থাকে না। আমিও মাতার প্রতি মন না দিয়ে তার ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেলুম। বারান্দায় গিয়ে এক মুহূর্তে আমার কী হলো জানি নে। আমার মনে এই কথাটা জেগে উঠল যে, মা আছেন। তখনই তার ঘরে গিয়ে তার পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলুম। তিনি আমার হাত ধরে আমাকে বললেন, ‘তুমি এসেছ!’ এইখানে স্বপ্ন ভেঙে গেল।”

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...