মহিষাসুর কি শুধুই অসুর? মহাভারতে কি লুকিয়ে আছে অজানা ইতিহাস?

বেদ এবং বেদ পরবর্তী মহাভারত পুরাণের সময়ও দেবতা এবং অসুরদের নিয়ে নানা মত প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এই দুই শত্রু বা প্রতিশ্রুদের নিয়ে নানা বিরোধের ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। তাঁদের পরিচয়, পুরাণে তাঁদের উদ্ভব নতুন তর্কের জন্ম দিয়েছে। মোটামুটি পুরাণে যা পাওয়া যায় তা হল দৈত্য-দানব এবং দেবতারা সকলেই একই পিতা কশ্যপের সন্তান। তাঁদের মা আলাদা। অদিতি ছেলেরা দেবতা, দিতির ছেলেরা দৈত্য এবং ধনুর পুত্র দানব। অদিতি, দিতি এবং ধনু এরা সকলেই কশ্যপের স্ত্রী। মূলত স্বর্গরাজ্যের ভূমি দখল নিয়েই এই দুই প্রতিশক্তির যুদ্ধ। স্বর্গ মর্ত্য পাতালের অধিপতি কে হবে সে নিয়েই বিরোধ। দেবতা, অসুর এবং দানবরা আসলে বৈমাত্রেয় ভাই। ‌ যদিও বৈদিক ব্রাহ্মণদের সময়ে দৈত্য দানবদের প্রধান বিশেষণ ছিল তাঁরা দেবতাদের ভাইপো, ভাই নয়। তবে বহু হাজার বছর আগে লেখা ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলিতে ভ্রাতৃব‍্য শব্দটির ব্যবহার হয়েছে যার অর্থ সহজ শত্রু অর্থাৎ জন্ম শত্রু। সে দিক থেকেও দেবতা এবং দানবকে বিরোধী পক্ষই বলা যায়।

 

অসুর হিসেবে মহিষাসুরের জীবন রাবণ কিংবা হিরণ্যকশিপুর মত নয়, বরং মহিষাসুর যথেষ্ট সোজা, সহজ এবং নির্বিরোধী। তবে লোভী এবং ক্ষমতাশালী হওয়ার ইচ্ছেযুক্ত। মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীভাগবত এবং স্কন্দ পুরাণের পৌরাণিক ভার্সনের অনেক আগেই মহিষাসুরের একটা মহাভারতীয় অবতার পাওয়া যায়। ‌ মহিষাসুরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য মহাভারতে স্কন্দ-কার্তিকেয়কে যুদ্ধযাত্রা করতে হয়েছিল দেবতাদের সেনাপতি হিসেবে অভিষিক্ত হয়ে। এই ভার্সন অনুযায়ী দুর্গা, চন্ডী কোন মহিষাসুরমর্দিনী নয়।

 

মহাভারত মতে দেবতাদের সঙ্গে অসুর, দানবদের একটা যুদ্ধ চলছিল এবং যে যুদ্ধ সহজাত। এখানে যেমনটা পাওয়া যায়, যে দৈত্য দানবদের অত্যাচারে পরাস্ত হয়ে দেবতাদের সৈন্য সামন্তরা হার স্বীকার করতে শুরু করেছিলেন সেই সময় দেবরাজ ইন্দ্র তাদের সাহস দেন। অস্ত্র তুলে নেওয়ার কথা বলেন। মহাভারতে মহিষাসুর কিন্তু অসুর নয়, দানব। তার মধ্যে পশু মহিষের বৈশিষ্ট্য নেই। তবে তার নাম সেখানে মহিষ-দানব যে বিখ্যাত দানকগুলোর অন্যতম সেনাপতি।

 

মহাভারতে মহিষ দানবকে বধ করেছিলেন স্কন্দ কার্তিকেয়। তাঁকে যুদ্ধে সমস্ত দেবতা অস্ত্র দান করেছিলেন।  স্কন্দকার্তিকেয়কে সমস্ত দেবতা অস্ত্র দান করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। মহাসেন কার্তিকেয় যখন মহিষ-দানবের সামনে এসে দাঁড়ান তখন তাঁর পরনে রক্তাম্বর, গলায় লাল ফুলের মালা এবং তাঁর সোনার বরন রথের ঘোড়াগুলির রংও ছিল কাঞ্চি লাল। কার্তিকের আবির্ভাবে দৈত্য সেনারা পালাতে শুরু করেন।

 

মহাভারতে কার্তিকের সঙ্গে মহিষাসুরের যুদ্ধের কোন সম্পূর্ণ বিবরণ নেই। এখানে যুদ্ধ পর্ব যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত। মহিষ দানবকে দেখামাত্রই মহাসেন কার্তিক ও তার দিকে ভয়ংকর শক্তি নিক্ষেপ করেন যা মহিষ ধানককে ধ্বংস করে দিতে পারে। এই শক্তি-অস্ত্রের নিপুণ ব্যবহারের মাধ্যমেই পরাজিত হন মহিষ দানব। যুদ্ধের বর্ণনাটি এমন ছিল যে শক্তি অস্ত্রের নিপুণ নিক্ষেপ এবং তার সঙ্গে মহাসেন কার্তিকেয়র অলৌকিক শক্তি একবার অস্ত্রের আঘাতেই ধরাশায়ী হয়ে যান মহিষ-দানব। মহিষের মাথা ধড় থেকে আলাদা হয়ে যায়।

 

মহাভারতের কার্তিকের হাতে মহিষদানব নিধনের মধ্যে আলাদা করে কোন আড়ম্বর নেই। যুদ্ধে শক্তির লড়াই নেই। শুধু অস্ত্র তোলা এবং তা দিয়ে প্রতিপক্ষকে নিধন করা এতটুকুতেই শেষ।

 

অসুর শব্দটা যথেষ্ট পুরনো সময়ের, অসুর শব্দের অর্থ দেবতা হিসেবেই মানা হতো।।

ঋকবেদেও অনেক জায়গায় দেবতাদেরই অসুর বলা হয়েছে। এমনকি অসুরের মধ্যে অপাপবিদ্ধ কিছু ছিল না। মহাভারতে মহিষকে প্রধানত দানব বলা হলেও মাঝে মাঝে তাকে দৈত‍্য বলা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে মহিষের আবির্ভাব ঘটেছিল দৈত্যদের মাঝখান থেকে। রণক্ষেত্রে যে দানব বা দৈত‍্য সহজেই ধরাশায়ী হয়েছে। এখানে মহিষ শব্দটি ব্যবহারের বিশেষ অর্থ রয়েছে। সাধারণভাবে মহিষ শব্দের অর্থ ভারবীহী পশু ছাড়াও তার অন্য একটি গুরুত্ব রয়েছে। মহিষ রাগী পশু এবং বেশ শক্তিমান। অর্থাৎ দেবতার শক্তি এবং দৈত্যের শক্তি লড়াই। এভাবেই মহাভারতে অসুরের ব্যাখ্যা হয়েছে, এবং তা স্বাভাবিক দানবের ব্যাখ্যার খানিকটা অন্য স্তরের ব্যাখা হিসেবে ইতিহাসবিদরা বলেছেন।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...