সতীপীঠঃ রাজা দশরথ, ঋষি দুর্বাসা ও আদি শঙ্করাচার্যকে কৃপা করেছিলেন কাঞ্চীপুরমের ‘মা কামাক্ষী’

তামিলনাড়ুর কাঞ্চীপুরম। কাঞ্চীপুরমের ঠিক মধ্যিখানে রয়েছে দেবী কামাক্ষীর সুপ্রাচীন ও সুবিশাল মন্দির। আসলে, মন্দিরকে কেন্দ্র করেই এই কাঞ্চীপুরম শহর গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে নানান দেবদেবীর অসংখ্য মন্দিরও। তাই এই শহরকে ‘মন্দির শহর’ বলা হয়। দেবীর মন্দিরটি ঠিক কবে নির্মিত হয়েছে, তার সঠিক সময় নির্ণীত হয়নি। ভক্তেরা বলেন, সৃষ্টির সময় থেকেই এই মন্দির বর্তমান। ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর কোন এক সময় এই মন্দির নির্মিত হয়। গৌরবময় পল্লব রাজাদের রাজত্বকালে এই মন্দির বর্তমান ছিল। কাঞ্চীপুরম তাঁদের রাজধানী ছিল।

যাই হোক, কামাক্ষী দেবীকে এখানকার মানুষ আদর করে বলেন, ‘কামাক্ষী আম্মা’। প্রাচীনকাল থেকেই কাঞ্চীপুরম সমগ্র দেশে ‘কাঞ্চী’ নামেই প্রসিদ্ধ। তাই সারা ভারতের মানুষ দেবীর মন্দিরকে ‘কাঞ্চী কামাক্ষী মন্দির’ বলে থাকেন। এই মন্দির একান্নপীঠের অন্যতম এক পীঠ। এখানে দেবী সতীর নাভি পতিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। নাভি যেমন শরীরের কেন্দ্রস্থল, তেমনি ভক্তজনের বিশ্বাস, কামাক্ষী মন্দিরে যেখানে দেবীর নাভি পতিত হয়েছিল, সেটাই পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল। এই পীঠে দেবীর ভৈরব হলেন, ‘একাম্রনাথ’।

দক্ষিণ ভারতে সমস্ত প্রাচীন মন্দিরের প্রবেশপথেই সুবিশাল প্রস্তরনির্মিত তোরণ থাকে। সেই তোরণ অসাধারণ শিল্পগুণসম্পন্ন সুন্দর সব ভাস্কর্যে সুসজ্জিত। পৌরাণিক কাহিনি এই সব ভাস্কর্যের বিষয়। এই তোরণকে বলে, ‘গোপুর’ বা ‘গোপুরম’। কাঞ্চীর এই মন্দিরের গোপুরমের মাথায় রয়েছে একসারি সোনার কলস। সূর্য ও চাঁদের আলোয় তারা সোনালি আভা ছড়িয়ে সমস্ত চরাচর মোহময় করে রাখে। মন্দিরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, দেবীর মন্দিরকে মধ্যে রেখে মন্দিরপ্রাঙ্গণ দুটি ভাগে বিভক্ত। বড় কাঞ্চী ও ছোট কাঞ্চী। বড় কাঞ্চীতে একটি বড় শিব মন্দির ও তার সঙ্গে কিছু ছোট ছোট বিষ্ণু মন্দির রয়েছে। আর ছোট কাঞ্চীতে একটি বড় বিষ্ণু মন্দির ও তার সগে কিছু ছোট ছোট শিব মন্দির রয়েছে।

দেবীর গর্ভগৃহের দরজাকে বলা হয় ‘বিল্বদ্বার’ এবং গর্ভগৃহকে বলা হয়, ‘গায়ত্রী মণ্ডপ’। গায়ত্রী মণ্ডপে রয়েছে চব্বিশটি স্তম্ভ। এই স্তম্ভগুলোকে গায়ত্রী ছন্দের চব্বিশটি অক্ষর বলে মনে করা হয়। গর্ভগৃহের চারটি দেওয়ালকে চারখানি বেদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। শাস্ত্রীদের মতে, এই গর্ভগৃহে দেবী স্থূল, সূক্ষ্ম ও শূন্য—এই তিনরূপে বিরাজ করেন। স্থূলরূপে দেবী মূর্তিতে বিরাজমান। মূর্তিটি কালো পাথরে তৈরি। মূর্তিটি সুপ্রাচীনকালের। ভক্তজনের বিশ্বাস, মূর্তিটি কোন ভাস্করের হাতে তৈরি হয়নি। এটি স্বয়ম্ভূ মূর্তি। নিজে নিজেই সৃষ্টি হয়েছে। কিংবদন্তি অনুসারে, দেবী আদ্যাশক্তি ভণ্ডাসুরকে বধ করার জন্য আবির্ভূত হন। তারপর তাকে বধ করার পর এই স্থানে যোগাসনে বসেন এবং জগতের কল্যাণের জন্য চিরকাল অধিষ্ঠিত হয়ে থাকার জন্য প্রস্তরমূর্তিতে রূপান্তরিত হন।

দেবীর ভণ্ডাসুরকে বধ করার জন্য যে রুদ্ররূপ ধারণ করেছিলেন, সেই রূপেই তিনি যোগাসনে বসে প্রস্তরমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন; পরবর্তীকালে আদি শঙ্করাচার্য দেবীকে ধ্যানে তুষ্ট করেন। তখন তাঁর প্রার্থনায় দেবী রুদ্ররূপ ত্যাগ করে শান্তরূপে আবির্ভূত হন এবং মূর্তিতেও সেই রূপান্তর ঘটে। সেই থেকে এখনও দেবী শান্তরূপে বিরাজমান। দেবী কিন্তু আদি থেকেই যোগভঙ্গিমায় পদ্মাসনে বসে আছেন। দেবীর চারটি হাত। নীচের দুই হাতে ধারণ করে আছেন আখ ও পঞ্চপুষ্প এবং ওপরের দুই হাতে রয়েছে পাশ ও অঙ্কুশ। তাঁর নাকে দক্ষিণ ভারতীয় দীর্ঘ নথ। মাথায় উন্নত মুকুট। অঙ্গে সুদৃশ্য উজ্জ্বল রঙদার শাড়ি। দেবীর বাঁ-দিকে রয়েছেন দেবী বারাহী ও অরূপলক্ষ্মীর ছোট্ট মূর্তি। ডানদিকে চিত্রপটে রয়েছেন ভগবান বিষ্ণু ও স্বরূপলক্ষ্মী।

দেবীর সামনে একটি টিয়াপাখি রয়েছে। আসনের নীচে রয়েছে, ‘শ্রীচক্র’। প্রস্তরনির্মিত গৌরীপট বা যোনি-আকৃতির এই চক্রের মধ্যিখানের বিন্দুতে অবস্থান করেন দেবী, আর তাঁকে ঘিরে রয়েছেন আটজন ভগদেবী। কিংবদন্তি অনুসারে, এই চক্র প্রতিষ্ঠা করেন স্বয়ং ঋষি দুর্বাসা। কিংবদন্তি অনুসারে, ঋষি দুর্বাসা একবার অভিশাপ খণ্ডনের জন্য কামাক্ষী দেবীর এই মন্দিরে এসে তপস্যা করেন। তখন দেবীর উপাসনার জন্য তিনি এই শ্রীচক্র স্থাপন করেন। এই চক্র সর্বদা গোলাপি পদ্মে ঢাকা থাকে বলে, এই চক্র দর্শনার্থীরা সহজে দেখতে পান না। দেবীর নিকটে রুপোমণ্ডিত একটি ছোট্ট স্তম্ভ রয়েছে। এই স্তম্ভের মাথায় একটি ছিদ্র রয়েছে, একেই দেবীর নাভি-হিসেবে বর্ণনা করা হয়। দেবী ও এই নাভিস্তম্ভের কাছে নিঃসন্তান ভক্তজন সন্তানলাভের জন্য প্রার্থনা জানান।

দেবীর মন্দিরে সন্তানলাভের জন্য প্রার্থনা জানানোর পিছনে একটি পৌরাণিক কাহিনি আছে। তাতে বলা হচ্ছে যে, দেবী কামাক্ষী ইক্ষ্বাকু বংশের কুলদেবী। এই বংশের রাজা অযোধ্যাপতি দশরথের চার রানি থাকা সত্ত্বেও এবং দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরও তাঁদের কোন সন্তান না-হওয়ায় দশরথ এই মন্দিরে আসেন। এখানে তিনি ‘পুত্রকামেচ্ছা যজ্ঞ’ সম্পন্ন করেন। তখন তাঁর রাম-লক্ষ্মণাদি চারটি পুত্রের জন্ম হয়। এই কাহিনিকে মাথায় নিয়ে নিঃসন্তান দম্পতিরা আজও এই মন্দিরে সন্তানপ্রাপ্তির কামনা জানাতে আসেন।

আগেই বলেছি যে, দেবী কামাক্ষীর মন্দিরের সঙ্গে হিন্দুধর্মের মহান সংস্কারক আদি শঙ্করাচার্যের ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। দেবীর মন্দির প্রাঙ্গণে আদি শঙ্করাচার্যের পৃথক একটি মন্দির আছে; যেমন আছে শ্রীচক্রের প্রতিষ্ঠাতা দুর্বাসা ঋষির। যাই হোক, আদি শঙ্করাচার্য দেবী কামাক্ষীর এই মন্দিরে দীর্ঘদিন তপস্যা করেছেন। রচনা করেছেন দেবীর অসাধারণ স্তবগাথা, ‘সৌন্দর্য লহরী’। এই গাথা গেয়ে আজও দেবীর অর্চনা করা হয়। শঙ্করাচার্য দেবীর কৃপা লাভ করে প্রথম দেবীর পুজো-পদ্ধতি সুষ্ঠু নিয়মে বিধিবদ্ধ করেন। সেই জন্য মন্দিরে বসেই রচনা করেন, ‘সৌভাগ্য চিন্তামণি কল্প’ নামের শাস্ত্রগ্রন্থ। তাঁর এই শাস্ত্রগ্রন্থ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেই কামাক্ষী মন্দিরে আজও দেবীর পুজো হয়। তাঁর প্রবর্তন করা নিয়ম অনুসারে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের ব্রাহ্মণ দেবীর পুজো করেন। দেবীর এই পুরোহিতদের বলা হয়, ‘শাস্ত্রী‘। বহুদিন ধরেই এই সাতজনের মধ্যে দু’জন কাঞ্চীর কামাক্ষী মন্দিরে পুজো করেন এবং বাকি পাঁচজন পুজো করেন থাঞ্জাভুর কামাক্ষী মন্দিরে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাতজনের মধ্যে এই পাঁচজন পুরোহিত হঠা থাঞ্জাভুরের কামাক্ষী মন্দিরে শঙ্করাচার্যের নিয়ম ভেঙে পুজো করতে গেলেন কেন? কাঞ্চীপুরমে কামাক্ষী মন্দির থাকতে থাঞ্জাভুরে আবার কেন দেবীর মন্দির গড়ে উঠল?

দুটো প্রশ্নের পেছনে একটি কাহিনি রয়েছে। দেবী কামাক্ষী ভগবান শিবকে বিবাহ করার জন্য এখানে কঠোর কঠিন তপস্যা করেছিলেন। সূচের অগ্রভাগে একপায়ে দাঁড়িয়ে দেবী তপস্যা করেছিলেন। এই তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শিব বিবাহে সম্মত হয়েছিলেন। তাঁদের বিবাহ হয়েছিল ফাল্গুন মাসে আকাশে উত্তরা নক্ষত্র বিরাজ করছিল, তখন। দেবীর কঠোর তপস্বিনী মূর্তিকে বলা হয়, ‘বঙ্গারু কামাক্ষী’। দেবীর এই তপস্বিনীরূপ সোনার পাতে খোদাই করে এঁকে কাঞ্চী কামাক্ষী মন্দিরে রাখা হয়েছিল। এই চিত্র কাঞ্চী কামাক্ষী দেবীর সঙ্গেই পুজো করা হত সুপ্রাচীনকাল থেকে। কিন্তু একবার মন্দিরে শত্রুর আক্রমণের আশঙ্কায় ‘বঙ্গারু কামাক্ষী’ দেবীর সেই স্বর্ণনির্মিত চিত্র গোপনে থাঞ্জাভুরে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এবং সেখানেই তাঁর পুজো শুরু করা হয়। সুতরাং, এই দুই মন্দিরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে।

দেবীর ‘কামাক্ষী’ নামের অন্য একটি গভীর তাৎপর্য আছে। ‘কা’ অর্থাৎ দেবী সরস্বতী, ‘মা’ অর্থাৎ দেবী লক্ষ্মী এবং ‘অক্ষী’ অর্থাৎ চোখ। এখান থেকেই বলা হয় যে, যে দেবীর দুই চোখে লক্ষ্মী ও সরস্বতী বিরাজমান; তিনিই দেবী কামাক্ষী। তাঁকে দর্শন করলে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মতো দুই মহাদেবীকে দর্শনের পুণ্যও লাভ হয়। তাই দেবীদর্শনের জন্য নিত্যদিন ভক্তদের ঢল নামে। বিশেষ বিশেষ দিনে মন্দিরপ্রাঙ্গণে জনসমুদ্রের দেখা মেলে। বিশেষ দিন কোনগুলো?

আগেই বলেছি যে, দেবী বঙ্গারু কামাক্ষীর সঙ্গে ফাল্গুন মাসে শিবের বিয়ে হয়েছিল। সারা দেশে এই সময় ‘মহাশিবরাত্রি’ ব্রত পালন করেন অসংখ্য পুণ্যার্থী মানুষ। ভক্তজনের মধ্যে এই সময় কারও বিয়ের দিন সমাগত হলে তারা অবশ্যই মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে দেবীর আশীর্বাদ নিয়ে আসে। দেবী এই সময় অর্থাৎ আপন বিবাহের এই মাসে নিত্যদিন নৌকোবিহারের মধ্য দিয়ে আনন্দযাপন করেন। ভক্তজন দেবীর এই বিহার দর্শন করে ধন্য হন। নৌকোবিহারের জন্য দেবীর ছলনমূর্তি নিয়ে আসা হয়। এই মূর্তি দেবী মন্দিরের পাশেই একটি মন্দিরে রাখা থাকে। চৈত্র মাসের ও শারদীয়া নবরাত্রি উৎসব এই মন্দিরে খুব ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। এছাড়া প্রতি মাসের পূর্ণিমা তিথিতেও এই মন্দিরে দেবীর বিশেষ পূজা হয়। প্রতি বছর মাঘ মাসে দেবীর ‘ব্রহ্মমহোৎসব’ পালিত হয় দশদিন ধরে। এই উৎসবে দেবী ছলনমূর্তিতে সাধারণের মাঝে এসে মন্দিরপ্রাঙ্গণে সোনার সিংহ ও রুপোর রথে চড়েন। চৈত্র মাসের প্রথম দিনটিকে এখানে বছরের প্রথম দিন ধরা হয়। এদিন দেবী সোনার রথে চড়ে নতুন বছরের শুভসূচনা করে ভক্তজনকে আশীর্বাদ দেন। বলাই বাহুল্য, এই বিশেষ উৎসবের দিনগুলোতে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মন্দিরে হাজির হন লক্ষ লক্ষ ভক্ত, অর্জন করতে চান মায়ের বিশেষ কৃপা।।...

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...