'মাইকেলের ভ্রাতুষ্পুত্রী' নয়, কলম দিয়েই মানুষ চিনেছিল মানকুমারী বসুকে

ছোট্ট মেয়েটা একটা খাতা নিয়ে ঘুরছে চারিদিক। কেউ যদি খাতাটা বাঁধিয়ে দেয়, একটা মলাট করে দেয়! সেই মেয়েটা নিজের এক বোনকে সেই খাতাটা দিয়েছিল। সেই বোনও পড়াশোনা ও‌ লেখালেখির প্রতি আগ্রহী ছিল। খাতাটি নিয়ে বোন বলল "খাতাখানা আমার কাছে দে, আমি তোকে গান লিখিয়া দিব।"

ছোট্ট মেয়েটা ‌খাতাটা বাঁধানোর পর হাতে পেয়ে এক দৌড়ে পালায় বোনের কাছ থেকে। এই খাতাটা আসলেই তার অন্তরের ঝাঁপি খোলার চাবিকাঠি যে! এই খাতা জুড়েই প্রথমবার সেই ছোট্ট মেয়েটা লিখেছিল তার প্রথম লেখা। ছোট্ট মেয়েটার প্রথম সৃষ্টি জন্ম নিয়েছিল এই গোপন খাতায়। তারপর কলম থামেনি। নদীর স্রোতের মত এই মহিলা কবির লেখা বয়ে গেছে। ঝর্নার মত এগিয়েছে। এমনই অনন্যা এক মহিলা কবি ছিলেন মানকুমারী বসু।

১২৭১ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৮৬৩ সালে যশোর জেলার শ্রীধরপুর গ্রামে জন্ম মানকুমারী বসুর। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি তুমুল টান। কিন্তু বড় অভিমানিনী মেয়ে। তাই আদর করে বাবা নাম রেখেছিলেন মানকুমারী বসু।

বাবা আনন্দমোহন দত্ত চৌধুরী, মা শান্তমণি দেবী। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে মানকুমারী সবচেয়ে ছোট অর্থাৎ চতুর্থ সন্তান ছিলেন। ছোটবেলা থেকে বাবার আগ্রহেই পড়াশোনা শিখেছিলেন।

অন্তরে কিছু সৃষ্টির তাগিদ তাঁকে সঙ্গ দিত সবসময়। বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রথম মহিলাদের লেখা দেখেন মানকুমারী। তারপর নিজের লেখার ইচ্ছের চারাগাছটা নড়ে ওঠে। একটা বাঁধানো গোপন খাতায় মানকুমারী নিজের প্রথম গদ্য লেখেন 'লাইবাইটের উপাখ্যান'। 

চরিতাবলির অদ্ভুত নাম শুনেই লাইবাইট নামটা তাঁর মাথায় এসেছিল। নিজের স্মৃতিচারণায় মান কুমারী বলেছেন "যাহা হউক সেই লাইবাইট আমার প্রথম রচনা। মনে হয়, তাহা গদ্য। তারপর আমি পদ্য রচনায় প্রবৃত্ত হইলাম।"

কবিতার মাধ্যমে নিজের সৃষ্টির ঝুলি উজাড় করে দেন মানকুমারী।

"রাখো রাখো যবে ভাই বচন আমার,

ঈশ্বরের পদে কর কর নমস্কার।"

ছোট্ট ছোট্ট শব্দে নিজের সৃষ্টির সাধনা করতে থাকেন মান কুমারী।"

১২৭৯ বঙ্গাব্দের ৭ মাঘ বসু পরিবারের বিদ্বান এক ছেলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পরেও স্বামীর উৎসাহে ও শিক্ষায় মানকুমারীর কাব্যচর্চা চলতে থাকে।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভাইঝি ছিলেন। মানকুমারীর কাব্যে তাই মধুসূদন দত্তের অমিত্রাক্ষর ছন্দের বিশেষ প্রভাব দেখা যায়।

"দুরস্ত যবন যবে ভারত ভিতরে

পশিল আসিয়া পুরন্দর মহাবলী,

কেমনে সাজিলা রণে, প্রিয়তমা তার,

ইন্দুবালা কেমনে বা করিলা বিদায়,

কৃপা করি কহ মোরে হে কল্পনা দেবী!

কেমনে বিদায় বীর হল প্রিয়া কাছে।"

'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল এই কবিতাটি। মানকুমারীর স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় এটি তার প্রথম প্রকাশ্যে প্রকাশিত লেখা। প্রশংসা ও সমাদর দুই পেয়েছিল কবিতাটি। সৃষ্টির জগতে এটাও সকলে জানতে পারেন মানকুমারী বসু মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভ্রাতুষ্পুত্রী।

খুব কম বয়সে স্বামীকে হারিয়েছিলেন মানকুমারী বসু। স্বামী-শোকের সময় তাঁর লেখায় তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিল। কবি মানকুমারী বসুর স্মৃতিলিপির তথ্যসূত্রের মাধ্যমে পাওয়া যায় তাঁর যন্ত্রণাআখ্যানের কথা। এই যন্ত্রনা তাঁকে দিয়ে লিখিয়েছিল গদ্য কাব্য 'প্রিয় প্রসঙ্গ'।

এছাড়াও তৎকালীন সময়ে বহু নামে পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন। তাঁর লেখায় কখনো প্রকাশ পেয়েছে ভালোবাসা কখনো দুঃখ। কখনো আবার তাঁর কবিতা দেশ, কালের গণ্ডি পৌঁছে গেছে বিশ্বের দরবারে।

সে সময় স্বদেশী আন্দোলন চলছিল। মানকুমারী বসুর কবিতায় সেই আন্দোলনের প্রভাব ছিল স্পষ্ট। তাঁর রচিত 'সাধের মরণ' , 'মায়ের সাধ' প্রভৃতি কবিতাগুলি একসঙ্গে স্মরণ-যোগ্য। কখনো মানকুমারী বসুর কবিতায় ভক্তি রস ফুটে উঠেছে।

কবিতার হেন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে মানকুমারী বসু সহজ, সাবলীলভাবে বিচরণ করেননি। এই মহিলা কবি রবীন্দ্রনাথের সময়ের কবি। কিন্তু তাঁর লেখায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সেভাবে পাওয়া যায় না। অনেক সমালোচকদের মতে তাঁর কবিতায় কল্পনার গভীরতা কম।

শুরুর দিকে সৃষ্টির তাগিদ থেকেই লিখতে শুরু করেন। কিন্তু এই লেখিকার সৃষ্টির পথে আলো ছড়িয়েছেন সর্বদা। তাঁর সৃষ্টির সুবাস ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। তাঁর সৃষ্টি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের অবদান রেখেছেন।

কবিতা ছাড়াও মানকুমারী বসু ছোটোগল্প রচনাতেও তাঁর দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। 'রাজলক্ষী', 'অদৃষ্টচক্র' এবং 'শোভা'-র জন্য তিনি কুন্তলীন পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া তাঁর 'পুরাতন ছবি' গল্পটিও পাঠকসমাজে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তাঁর গল্প সমাজের কথা বলেছে বারবার।

সাহিত্য-প্রতিভার জন্য কবি মানকুমারী বসু ১৯১৯ সাল থেকে আমৃত্যু ব্রিটিশ-ভারত সরকারের বৃত্তি লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৯ সালে তাঁকে 'ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক' এবং ১৯৪১ সালে 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৩৭ সালে চন্দননগরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে মানকুমারী বসু 'কাব্য সাহিত্য' শাখার সভানেত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন। ২৬ ডিসেম্বর ১৯৪৩ সালে কন্যা পিয়বালার খুলনার বাড়িতে এই কবি মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি নিজের একটি এপিটাফ রচনা করেছিলেন। কবিতাটির নাম 'অন্তিম'।

এই বাল্যবিধবা কবি কাজ নিয়ে মগ্ন থাকতেন। আড়ালে থেকে নিজের কাব্য-সাধনা চালিয়ে গেছেন আজীবন। অন্তঃপুরবাসিনী ও বাল্যবিধবা হলেও কবি মানকুমারী বসু ছিলেন স্বশিক্ষিতা। বাংলা কাব্যের জগতে তাঁর প্রবেশ ছিল নীরব, তবে কর্মজগতে প্রবেশ করে তাঁর মেধা আলোর মত ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। তবে নিজ গুণে তিনি সর্বদা উজ্জ্বল থেকেছেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...