ভাস্করানন্দ বলতেন ‘সাধু সর্বদা থাকবে আকাশ বৃত্তি অবলম্বন করে’

ছেলে মতি রামের ছেলেকে দেখে দাদু পন্ডিত মিশ্রী লালের মনে আনন্দ বেজায়! পুরো মিশ্র বাড়িতে  বয়ে গেলো আনন্দের বন্যা। কিন্তু সেই আনন্দ দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হল না, আনন্দের ঢেউ মুহূর্তের মধ্যেই বদলে গেল কান্নার রোলে! নবজাতকের আনন্দে মুখর বাড়ি যেন হয়ে উঠল শোকের বাড়ি! কারণ? মতিরাম বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছেন। পন্ডিত মিশ্রী লাল মিশ্রের একমাত্র সন্তান মতি রাম।

১৮৩৩ সালে শুক্লা সপ্তমীতে তার জন্ম। রূপে গুনে সে অতুলনীয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই পাণিনি ব্যাকরণ সমাপ্ত করে সে, যে কারণে পিতৃগর্বে গর্বিত একা পিতা নন, কানপুরের মৈথেলাল পুরের অধিবাসীরাও গর্বিত মতিরামকে নিয়ে। কিন্তু এই জ্ঞান পাণ্ডিত্য যে তার মনে গভীর বৈরাগ্যের সৃষ্টি করতে পারে তা বুঝতে পারেন নি পরিবারের কেউ।  এক বস্ত্রে কপর্দকহীন অবস্থায় গৃহত্যাগ করে উজ্জয়নীতে চলে গেলেন।  সেখানে বহুদিন শ্মশানে বসে যোগ সাধনা করলেন, অনেক যোগী তান্ত্রিকের সান্নিধ্যে তার যোগ বিভূতি দিনে দিনে প্রকট হতে লাগল। তারপর গেলেন গুজরাটের মালব দেশে। সেখানে কয়েক বছর বেদান্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেন আবার উজ্জয়নীতে ফিরে এলেন মতিরাম।

সেখানে দাক্ষিণাত্যের ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি শ্রীপূর্ণানন্দ সরস্বতীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হল। পূর্ণানন্দ মতিরামকে সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত করলেন ও সন্ন্যাস গ্রহণের পর মতি রামের নতুন নাম হল ভাস্করানন্দ সরস্বতী, তখন তার বয়স মাত্র ২৭। নানা তীর্থ পরিক্রমার পর ভাস্করানন্দ এলেন কাশীধামে, সেখানেই শুরু হল তার কৃচ্ছ সাধনা, গঙ্গার বালুতটে শীতে,গ্রীষ্মে, বর্ষায় সমভাবে অবস্থান করে বিশ্বনাথজির আরাধনায় নিমগ্ন হলেন। স্বামীজীর এই যোগ সাধনার কথা লোকের মুখে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এরপর স্বামীজি এলেন দুর্গা বাড়ির নিকটে আনন্দবাগে।

মাটির নীচে গর্ত করে সেখানে তার আসন স্থাপন করলেন। একদিন এক রাজার কৌতূহল হল সন্ন্যাসীকে পরীক্ষা করে দেখবেন, এজন্য কয়েকজন রূপসী গণিকাকে তিনি নিযুক্ত করলেন। গভীর রাত্রে গণিকারা আনন্দবাগে ঢুকল, অজানা ভয়ে তাদের বুক কাঁপতে লাগলো, শুধু একজন সাহস করে এগোলো সন্ন্যাসীর দিকে কিন্তু তখনই শোনা গেল সেই নারীটির আর্ত চিৎকার ‘বাঁচাও বাঁচাও’। অতর্কিতে কোথা থেকে এক বিরাট সাপ এসে তার পা দুটি জড়িয়ে ধরেছে।

সূর্যোদয় হওয়ার পর সাপটি গণিকাকে ছেড়ে ধীরে ধীরে চলে গেল তখন সেই নারী সন্ন্যাসীর পায়ে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন আর সন্ন্যাসী ও তাকে ক্ষমা করলেন। পরে সেই নারীর বিষয় সম্পত্তির ওপরে বিতৃষ্ণা জমে যায় ও সমস্ত কিছু ত্যাগ করে সাধন-ভোজনে তিনি দিন কাটাতে থাকেন। কাশীধামে শীতল প্রসাদ নামে স্বামীজীর এক শিষ্যের পুত্র দোতলা ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়। শীতলপ্রসাদ ডাক্তার কবিরাজ না ডেকে গুরুর কাছে এসে উপস্থিত হন শিষ্যটি কিছু বলবার আগেই স্বামীজি সমস্ত বুঝতে পারেন একটু গঙ্গাজল হাতে নিয়ে তাকে বললেন, এই গঙ্গাজলটুকু তোমার ছেলেকে খাইয়ে দাও স্বামীজীর দেওয়া গঙ্গা জল মুখে দেবার পর শীতল প্রসাদের পুত্র বেঁচে উঠলো। এরকম বহু ঘটনা ঘটতেই থাকে যাতে ধীরে ধীরে স্বামীজীর অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ পেতে থাকে।

ভাস্করানন্দ সবসময় বলতেন যে, “সাধু সর্বদা থাকবে আকাশ বৃত্তি অবলম্বন করে-আগামীকালের জন্য কোন কিছু সঞ্চয় করে রাখার অধিকার নেই তার।”একবার তার এক শিষ্য পরের দিনের জন্য কিছু রন্ধন কাষ্ঠ সংগ্রহ করে রেখেছিল বলে স্বামীজি তাকে তীব্র ভাষায় ভৎর্সনা করেছিলেন। কাশীর রাজা ঝুড়ি ভর্তি ফল পাঠিয়েছেন স্বামীর জন্য,তিনি উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে সেই ফল তিনি বিলিয়ে দিলেন সেবক রামচরণ লুকিয়ে কয়েকটি ফল রেখে দিয়েছিল। স্বামীজিকে পরে খাওয়াবে বলে, স্বামীজি সর্বজ্ঞ, তাই রামচরনের কীর্তি বুঝতে পেরে তাকে পরিহাস করে বললেন,“ কি হে তুমি পরমহংসের ভান্ডারা বানাচ্ছ নাকি? আমার খাওয়া হয়েছে,ভক্তদের জিহ্বা দিয়ে আমিও যে ফলগুলোর স্বাদ গ্রহণ করেছি।”

কাশ্মীরের মহারাজা একবার তাকে প্রণাম করতে এসে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার প্রণামী দিলেন , ভাস্করানন্দ তা স্পর্শ করে তৎক্ষণাৎ ফিরিয়ে দিলেন আর বললেন,“ কৌপীন পরে থাকি, এতসব টাকাকড়ি কোথায় রাখব?”এমন‌ই ছিলেন স্বামীজী, যার কৃপালাভ থেকে বঞ্চিত হননি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ভিখারী পর্যন্ত। মার্কিন সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন ভারত ভ্রমণে এলে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় ভারতে এসে আপনি যা দেখলেন তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কোনটি? মার্ক টোয়েন বলেছিলেন “বেনারস এবং হোলিম্যান অফ বেনারস” মার্ক টোয়েন তার নিজের রচিত গ্রন্থে ও স্বামীজি সম্পর্কে বিনম্র শ্রদ্ধা উল্লেখ করে লিখেছেন, “ভারতের তাজমহল অবশ্যই এক পরম বিস্ময় কর বস্তু যার সুমহান দৃশ্য মানুষকে আনন্দে অভিভূত করে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করে কিন্তু স্বামীজীর মতো মহান ও বিস্ময়কর জীবন তো বস্তুর সঙ্গে তার তুলনায় চলে না এই যে জীবন্ত এতে শ্বাস-প্রশ্বাস বয় এজে কথা বলে লক্ষ লক্ষ স্থাপন করে ঈশ্বর ভেবে ভক্তি করে।

গরিব জেলে লছমন মালা ছিল স্বামীজীর পরম ভক্ত কথিত আছে এক বৃহৎ জনসমাগমে নিজের আসনের পাশে তাকে ডেকে বসিয়েছিলেন স্বামীজি। তারপর এই লছমনের গলার ভজন শুনতে শুনতে সমাধিতে দেহ রক্ষা করেন তিনি। স্বামীজি যখন দেহ রক্ষা করেছিলেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৬৬ বছর আর সময়টা ছিলো ১৮৯৯। তাঁর দেহ রক্ষার সাথে সাথে ভক্তি সমাজে ও ভক্তদের মাঝে সৃষ্টি হয় এক গভীর শূন্যতা

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...