নবদ্বীপে মহাপ্রভুর বাড়িতে জন্মাষ্টমীতে পূজিত হন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর চৈতন্য বিগ্রহ

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত ।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ।

হে ভারত! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যূত্থান হয়, তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।

ধর্মের স্থাপনে বারবার তাঁর আবির্ভাব হয়েছে ধরাধামে। বাংলায় তিনি প্রেমের ঠাকুর। বাঁশি আর হাসিতে মন মজিয়েছেন বঙ্গবাসীর। কৃষ্ণপ্রেমের রসে ভেসে গিয়েছে বাংলা। কালীর দেশে শ্যাম আর শ্যামা এক অঙ্গে মিলে হয়েছেন কালীকৃষ্ণ। আয়ান ঘোষকে তিনি দেখা দিয়েছিলেন কালী রূপে। সে কাহিনী মনে রেখেও কালীপ্রেমী বাংলা বুকে রেখেছে কৃষ্ণকে।

IMG-20230905-WA0022 (1)

মথুরা বৃন্দাবন শ্রী কৃষ্ণের জন্ম আর বাল্যভূমি। আর নদের নিমাইয়ের দেশে তিনি মহাপ্রভুর গৌরহরি। শ্যাম বিহনে কেঁদে আকুল হতেন মহাপ্রভু চৈতন্য। তাঁর হা-কৃষ্ণ ধ্বনি ঘরছাড়া করে পথে নামিয়েছিল মানুষকে। মধুর বেদনায় বাঁশি বেজেছিল ভক্তের অন্তরে। আজও বাজে সেই সুর।

বৈষ্ণবতীর্থ নদিয়ার বিভিন্ন মন্দির সাড়ম্বরে পালিত হয় জন্মাষ্টমী উৎসব। দুই দিন দুই ভাগে পালিত হয় উৎসব। প্রথম দিনটি জন্মাষ্টমী। দ্বিতীয় দিন নন্দোৎসব।

নবদ্বীপের মহাপ্রভু বাড়িতে প্রাচীন প্রথা মেনে জন্মাষ্টমী পালিত হয়। তবে এখানে শ্রীকৃষ্ণ নয়, মহাপ্রভু বিগ্রহের অভিষেক হয়। সন্ন্যাস গ্রহণের পর চৈতন্যদেবের সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর আর কখনও দেখা হয়নি। কথিত আছে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চৈতন্যদেবের এই মূর্তি নির্মাণ করান। মহাপ্রভু বিগ্রহের সেবা করেই তিনি বাকি জীবন কাটান।

চৈতন্যদেব ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। ১৫১৩ সালে নির্মিত হয় ওই মূর্তি। যে নিম গাছের তলায় মহাপ্রভুর জন্ম হয়েছিল সেই গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয়েছিল চৈতন্যদেবের দারু বিগ্রহটি।

শান্তিপুরের বড় গোস্বামীবাড়িতে আছে হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন শ্রীরাধারমণ বিগ্রহ। শোনা যায়, এই কৃষ্ণমূর্তি পুরীতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে দোলগোবিন্দ নামে পূজিত হতেন। পরবর্তী সময়ে যশোররাজ বসন্ত রায় এই মূর্তি যশোরে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তিনিও রাখতে পারেননি মূর্তিটি। মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে বসন্ত রায়ের পরিবার মূর্তিটি রক্ষা করতে সেটিকে তাঁদের গুরুদেব শ্রীঅদ্বৈতের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। মথুরেশ গোস্বামী বিগ্রহটি শান্তিপুরে নিজগৃহে প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীমতী রাধার বিগ্রহটিও প্রায় তিনশো বছর আগে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

নবদ্বীপ শান্তিপুরে জন্মাষ্টমী উৎসব শুরু হয় সন্ধের চাঁদ দেখে। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, নাড়ি কাটা ইত্যাদী রীতি রেওয়াজ পালন করা হয়। পুজো শেষ হয় গভীর রাতে। বিগ্রহকে স্নান করিয়ে অভিষেক করা হয়। পরের দিন হয় নন্দোৎসব। ভোরে ঘুম ভাঙিয়ে ভোগ নিবেদন করা হয় রাধারমনকে। সারাদিন ধরেই চলে নানা ধরনের ভোগপর্ব। বাড়িতেই শুদ্ধাচারে দুধ দিয়ে ছানা, ক্ষীরের মিষ্টি তৈরি করা হয়। এখানে জন্মাষ্টমীর আরও এক আকর্ষণ ঝাল নাড়ু। চালের গুঁড়ো, ঘি, গোলমরিচ ইত্যাদি দিয়ে তৈরি।

প্রাচীন শ্যামচাঁদ মন্দিরে জন্মাষ্টমী উপলক্ষে অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয়। সারাদিন পদাববী পাঠ ও নাম সংকীর্তন চলে। এদিন দুপুরে অন্নভোগের পরে রাধারানিকে সরিয়ে রাখা হয়। নির্দিষ্ট তিথি ও আচার অনুষ্ঠান মেনে আঁতুরে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পরে নাড়ি কাটা অনুষ্ঠিত হয়।

পুরনো প্রথা অনুসারে সদ্যোজাত ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে যেমন তার নাড়ি কাটা হয় তেমনই গৃহদেবতার উদ্দেশে হলুদ সুতো কাটা হয় চাঁচারি দিয়ে। নবজাতককে রুপোর তৈরি বিভিন্ন খেলনা দেওয়া হয়। ১০০৮টি তুলসীপাতা চন্দন মাখিয়ে দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা হয়।

জন্মাষ্টমীর বিশেষ ভোগে থাকে তালের বড়া, লুচি, সুজি, পায়েস, মালপোয়া, নারকেল নাড়ু ইত্যাদি। পরের দিন সাড়ম্বরে পালিত হয় নন্দোৎসব।

সমাজবাড়িতে বাৎসল্য এবং মধুর রসে শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করেন এই মন্দিরের সেবায়েতরা। এখানে উৎসবের দুটি অংশ। দু’দিন ধরে উৎসব পালিত হয়। প্রথম দিন ব্রত এবং দ্বিতীয় দিন নন্দোৎসব।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...