যে সকল জীবরা রাত্রিবেলা আশ্রয় খুঁজে পায় না তাদের জন্য মন্ত্র রচনা করেছিলেন এই দেবী

ছোট্ট মেয়েটা বাবার কোলের কাছে বসতে সবচেয়ে পছন্দ করত। বাবা ছিলেন ঋষি ভরদ্বাজ। বেদচর্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন বাবা। বেদচর্চার নানা দিক মেয়েকেও আকৃষ্ট করেছিল।  
পড়াশোনার প্রতিও এই মেয়ের আগ্রহ ছিল প্রবল। তাই বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন বেদ নিয়ে পড়াশোনা। ‌ঋষি ভরদ্বাজের কন্যা রাত্রি অত্যন্ত বিদূষী এক বৈদিক নারী ছিলেন।

রাত্রির প্রথাগত বেদ শিক্ষাও ছিল। ঋষি ভরদ্বাজের উদ্যোগেই এই বেদশিক্ষা দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
তবে রাত্রিকে মূলত আকর্ষণ করেছিল একদম অন্যরকম একটা বিষয়। এই সমাজে যে সকল জীবরা রাত্রিবেলা নিজেদের আশ্রয় খুঁজে পান না তাদের জন্য মন্ত্র রচনা করেছিলেন দেবী অর্থাৎ রাত্রি।

ঋকবেদের দশম মণ্ডলের ১২৭ তম সূক্তের রচয়িতা দেবী রাত্রি। এই সূক্তগুলি মূলত রাত্রিসূক্ত নামেই পরিচিত।

একবার ঋষি ভরদ্বাজ একটি যজ্ঞ সম্পন্ন করে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন অনেক রাত। এক অপরিচিত ব্যক্তিকে রাস্তায় অবাঞ্ছিত-এর মত ঘুরে বেড়াতে দেখে কষ্ট হয় ঋষি ভরদ্বাজের। তিনি সেই ব্যক্তিকে বাড়িতে নিয়ে আসার কথাও ভাবেন। কিন্তু সেই ব্যক্তিটি রাজি হননি। সেই অপরিচিত ব্যক্তি ঋষি ভরদ্বাজকে বলেছিলেন যে মানুষ ছাড়াও এমন অনেক পরিশ্রান্ত, আশ্রয়হীন জীব প্রকৃতির কোলে নিরাপত্তার অভাবে রাত কাটাতে বাধ্য হন। মানুষ সাধারণত নিজের আশ্রয় গুছিয়ে নিতে পারে। এমনকি নিজেকে নিরাপদে রাখার নানান ব্যবস্থাও সে করতে পারে। কিন্তু অন্য সকল জীবরা এটা করতে পারে না। তাই আলাদা করে ঋষি ভরদ্বাজের দেওয়া কোন সুবিধাই ওই ব্যক্তি নিতে রাজি হননি।

এই বিষয়টা আশ্চর্য করেছিল এক গুণী ঋষিকে। ঋষি ভরদ্বাজ কিছুতেই বিষয়টা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিলেন না। এমনকী বেদচর্চাতেও মন দিতে পারছিলেন না। বাবাকে এমন হতাশ দেখে মেয়ে অস্বস্তিতে পড়ে যায়।

বাবার থেকে বিষয়টা জেনে খারাপ লাগে স্বয়ং ঋষি ভরদ্বাজ-কন্যা রাত্রিরও। পরবর্তীকালে এই বিষয়টাই রাত্রিকে অনুপ্রাণিত করেছিল রাত্রিসূক্ত রচনা করতে।

বাবার পথ অনুসরণ করে বেদচর্চাকেই জীবনের মূল ব্রত হিসেবে দেখেছিলেন ঋষিকা রাত্রি। তিনি বেদের মন্ত্র রচনা করেছিলেন। এই বেদের মন্ত্রে তিনি রাত্রিবেলা আশ্রয়হীন জীবদের নিরাপত্তা দেওয়ার মন্ত্রের কথা বলেন।

তাঁর রচিত মন্ত্রগুলি মূলত প্রার্থনামূলক। রাত্রিবেলা আশ্রয়হীন জীবদের নিরাপদে রাখার বা তাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করার ক্ষেত্রে এই মন্ত্র উচ্চারণ করা যায়।

বেদচর্চা এবং নারী স্বাধীনতার কথা বললেও রাত্রি মমতাময়ী এক বৈদিক বিদূষী নারী ছিলেন। তাঁর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মমতা মিশে থেকেছে সবসময়। এই দিক দিয়ে বৈদিক নারী রাত্রি সব সময়ই অনন্য।

রাত্রি রচিত মন্ত্রগুলিতে অন্ধকারকে নিজের মধ্যে ধারণ করে রেখেও চারিদিকে আলো ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দেবী রাত্রি অন্ধকারকে আশ্চর্য শোভার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন। এমনকি তিনি রাতকে অন্ধকারের প্রতিনিধি হিসেবে বললেও তার সঙ্গে ভোরের সম্ভাবনাকে আসলে আলোর সম্ভাবনার মত করে দেখিয়েছেন। তাই তো অন্ধকারে থাকা সকল জীবদের আলোর পথ খুজতে শিখিয়েছেন এই বৈদিক নারী।

বর্তমান যুগের বিচারে রাত্রির মত বৈদিক নারীরা আজও এই সমাজের পথপ্রদর্শক।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...