তাঁর সৃষ্টি হয়েছিল স্বামীর জন্য, যদিও পরবর্তীকালে তিনি নিজগুণে নিয়ন্ত্রণ করেছেন বৈদিক সমাজ

ঋকবেদ, মহাভারতের অরণ্যপর্ব এবং গিরিধর রামায়ণে লোপামুদ্রার জন্মের কথা পাওয়া যায়। যে সকল বিদূষী বৈদিক নারীদের আমরা বৈদিক সমাজের আদর্শ হিসেবে দেখেছি তাদের মধ্যে লোপামুদ্রা অন্যতম। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত বিদূষী, মেধাবী, বুদ্ধিমতী ছিলেন লোপামুদ্রা।

ঋষিকা লোপামুদ্রা মননশীল এক নারী ছিলেন। লোপামুদ্রার জন্ম নিয়ে নানান তথ্য পাওয়া যায় ইতিহাসে। কথিত আছে, লোপামুদ্রা ঋষি অগস্ত্যর বরে রাজা বিধর্ভের এক কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন।

রাজা বিধর্ভ দীর্ঘদিন ধরে কঠোর তপস্যা করেছিলেন এক  বুদ্ধিমান, মেধাবী সন্তান পাওয়ার জন্য। সেই তপস্যায় তিনি তুষ্ট করেছিলেন ঋষি অগস্ত্যকে। যদিও ইতিহাস বলে ঋষি অগস্ত্যর এই সৃষ্টির পেছনেও ছিল অন্য কারণ।

একদিন বনের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করার জন্য দিব্যদৃষ্টিতে ঋষি অগস্ত্য দেখেন ওঁর পিতৃপুরুষেরা গাছের ডাল থেকে নতমস্তকে ঝুলছেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তাঁরা জানান যেহেতু ব্রম্ভতেজের  অধিকারী হয়েও অগস্ত্যের কোন সন্তান নেই তাই বংশ লোপ পেতে চলেছে বলে তাদের এই অবস্থা। ঋষি অগস্ত্য তখন বাধ্য হন বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নিতে।

ঋষি অগস্ত্যের মনের মত কন্যা পাওয়া ছিল দূরূহ। তিনি তাই ঠিক করেছিলেন তিনি নিজেই এক সর্বগুণ সম্পন্ন নারীর সৃষ্টি করবেন। যে নারী অন্য কোন পরিবারে বড় হবে  কিন্তু   পরবর্তীকালে তাঁর স্ত্রী হিসেবে তাঁকে আপন করে নেবে।

এই সময়ই রাজা বিধর্ভ সন্তানলাভের জন্য তপস্যা করছিলেন। ঋষি অগস্ত্য তাঁকে বর হিসেবে এক সন্তানের জন্মের আশীর্বাদ করেন। এই সন্তান ছিলেন লোপামুদ্রা।

লোপামুদ্রা জন্মের পর বড় হয়ে উঠতে লাগলেন রিজা বিধর্ভের কাছে। ছোট থেকেই বিদূষী ছিলেন, বুদ্ধিমতী ছিলেন। অপরূপ সুন্দরীও ছিলেন লোপামুদ্রা।

লোপামুদ্রা বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠলে ঋষি অগস্ত্য এসেছিলেন সুন্দরীর পানি প্রার্থী হয়ে। এদিকে রাজকন্যাকে অরণ্যে বিচরণকারী এক ঋষির হাতে তুলে দিতে রাজি হলেন না বিধর্ভ। অগস্ত্যের কৌমার্যের ব্রত ভঙ্গ হওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল সে সময়। কিন্তু  লোপামুদ্রার পছন্দ হয়ে যায় সেই জঙ্গলে বিচরণকারী ঋষি অগস্ত্যকে।

বাবাকে অগ্রাহ্য করে তিনি বিয়ে করেন অগস্ত্যকে। লোপামুদ্রার সংসারে তেমন আগ্রহ ছিল না। এছাড়াও তিনি দেখলেন স্বামী বেশিরভাগ সময়ই নিজের কাজ, ধ্যান, সাধনা নিয়ে মগ্ন থাকেন।সংসারের যাবতীয় কাজ , দায়িত্ব তাঁর ওপরে ছিল। লোপামুদ্রা সাময়িক মেনে নিলেও পরের দিকে তাঁর মন বিদ্রোহ করতে থাকে।

দীর্ঘদিন ধরে আনুগত্যের সঙ্গে স্বামী-সেবা করার পর লোপামুদ্রা বুঝতে পেরেছিলেন কোথাও অন্তরের ইচ্ছের ঘাটতি হচ্ছে তাঁর ভেতর। তিনি নিজের অন্তরকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।

তখনই তিনি বেদচর্চা শুরু করেন। শুরু করেন জ্ঞানের সাধনা করা। বেদের মন্ত্র রচনা করতে শুরু করেন লোপামুদ্রা। সাধনায় মুগ্ধ হন ঋষি অগস্ত্য।

লোপামুদ্রার জ্ঞানই স্বামী অগস্ত্যকে সংসারধর্মী করে তোলে। তিনি স্বামীকে বোঝান সংসার ধর্ম ছাড়া শুধু ব্রহ্মচর্যে এই জীবন অসম্পূর্ণ। লোপামুদ্রার স্তোত্রেও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের গভীরতার কথা বলা হয়েছে।

ইতিহাসবিদ ডক্টর রমেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়-এর মতে লোপামুদ্রার পুরুষ ও নারীর সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলা হয়েছে।ঋষিকা দীর্ঘদিন ধরে তপস্যা করেছেন তারাও নারী বা নারী শক্তির প্রতি কখনো অনীহা দেখাননি।সে কথাই বলা রয়েছে লোপামুদ্রার রচিত স্তোত্রে।

স্বামী অগস্ত্যকে তিনি এটাও বুঝিয়েছিলেন শুধু সন্তান পাওয়ার জন্য বিয়ে করলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে গভীরতা গড়ে ওঠে না।সেরা মুদ্রার দেখানো পথ অনুসরণ করেছিলেন ঋষি অগস্ত্য সংসারধর্মে ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁদের সন্তান জন্ম নিয়েছিল পরবর্তীকালে।

ঋকবেদের প্রথম মন্ডলের ১৭৯ নম্বর সূক্তের দ্রষ্টা ছিলেন লোপামুদ্রা। এই সূক্তে মোট ছটি মন্ত্র রচনা করা হয়েছিল। এই মন্ত্রগুলোতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে।

যে সকল বিদূষী ঋষিকারা বর্তমান প্রজন্মের ক্ষেত্রেও পথ দেখিয়েছেন লোপামুদ্রা তাদের মধ্যে অন্যতম।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...