জীবনের বারোমাস্যায় জড়িয়ে লক্ষ্মীপুজোর পাঁচালি

সাদা রংয়ের ছোট ছোট পায়ের ছাপ। মেঝে, চৌকি, উঠোন জুড়ে আল্পনা। দূর কোন প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে পাঁচালির সুর। মন্ত্রে মিশে থাকছে শুভকামনা। শ্রী শ্রী লক্ষ্মী দেবীর ব্রতকথা পাঁচালি ও বারোমাস্যা আসলে জীবনের প্রতিরূপ। প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখের কথাই মিশে থাকে লক্ষী দেবীর পাঁচালিতে। দুর্গাপুজোর পরে অনুষ্ঠিত হওয়া কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় যে মন্ত্র উচ্চারিত হয় তা আসলে জীবনের বারোমাস্যা।

বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীবার হিসেবে মানা হয়। বাংলার ঘরে ঘরে মহিলারা সেদিন লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করেন। সেই একই পাঁচালি আবার পাঠ করা হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন। প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে একটা সেতু গড়ে ওঠে দুর্গাপুজোর পরে উদযাপিত হওয়া এই কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার।

“দোল পূর্ণিমা নিশীথে নির্মল আকাশ/ মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস

লক্ষ্মী দেবী বামে করি বশি নারায়ণ/ কহিতেছে নানা কথা, সুখে আলাপন।”

এ যেন স্বামী-স্ত্রীর প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখের কথা বলার মুহূর্তের রচনা। পাঁচালীর এই কয়েকটা শব্দের সুতোয় জুড়ে যায় বাংলার ঘরে ঘরে সম্পর্কের অবয়ব।

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর নিয়ম, নীতিগুলো আসলে মানুষের বিশ্বাস, নিষ্ঠা আর ভক্তির উদযাপন। কোথাও যেন ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষকে বেঁধে দেওয়া। এই লক্ষ্মীপুজোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম পাঁচালী পাঠ। এই পাঁচালী পাঠ আসলে জীবনের একঘেয়েমি ভরা প্রাত্যহিকতার উদযাপন। লক্ষীপুজোর পাঁচালীতে থাকে লক্ষ্মীপুজোর যাবতীয় মন্ত্র। শুরুর মন্ত্রকে বলা হয় আহ্বান মন্ত্র। এই মন্ত্র উচ্চারণ করে লক্ষীর ঘটে ফুল দিয়ে পুজো শুরু করা হয়। হাতে ফুল নিয়ে পাঁচালি পড়তে হয়। শেষে শাঁখ বাজিয়ে পুজোর সমাপ্ত করা হয়।

তবে লক্ষ্মীপুজোর এই পাঁচালি পাঠ শুধু ভক্ত আর দেবতার সম্পর্কের কথা বলে না। এখানে মিশে থাকে জীবন। এই পাঁচালির সুর, ছন্দ সবকিছুই শিল্পের মত করে ভালবাসার সুতোয় গাঁথা।

জীবনের দুঃখ-কষ্ট নিয়েও কথা বলা রয়েছে এখানে। লক্ষ্মীর পাঁচালিতে দুর্ভিক্ষ, খরা, বন্যা এই সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথাও বলা হয়েছে।

“অন্নাভাবে শীর্ণকায় রোগে মৃতপ্রায়/ আত্মহত্যা কেহবা করিছে ঠেকে দায়।

কেহ কেহ প্রাণাধিক পুত্রকন্যা সবে/ বেচে খায় হায় হায় অন্নের অভাবে।”

পাঁচালির এই অংশটুকু একটা অন্ধকার সময়ের কথা বলে। তবে শুধু অন্ধকার সময়ের কথা বলেই থেমে থাকে না এই পাঁচালি। শোনায় আশার কথা। এই পাঁচালি লক্ষ্মী অর্থাৎ শুভকামনা বা মঙ্গল চিন্তার সঙ্গে যুক্ত কিছুর আরাধনা করতে বলে।

“অন্নপূর্ণা অন্যরূপা ত্রিলোকজননী/ বলো দেবী, তবু কেন হাহাকার শুনি।”

লক্ষ্মীর পাঁচালী আসলে সু বা ভাল কিছুর জন্য প্রার্থনা। এই বাংলার রীতি অনুযায়ী লক্ষ্মী পুজোর দিন পাঁচালী পাঠ করা ছাড়াও ১০৮ বার গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার কথা বলে। লক্ষ্মীপুজোর পাঁচালী ছোট ছোট জিনিসে খুশি হতে শেখায়। তাই উপচারে কড়ি রেখে দেওয়া হয় বাড়িতে।

কোজাগরী লক্ষ্মীপূজোর দিন সারারাত জেগে দেবীর আরাধনা করা হয়। এই আরাধনায় আসলে জীবনের কথা লুকিয়ে থাকে। জীবনের কথাই বলা হয় লক্ষ্মীপুজোর এই পাঁচালী পাঠ জুড়ে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...