কালী কথা: বাঁকুড়ার বড় কালীতলার বিপ্লবী কালী

কালী মন্দিরের সঙ্গে যেমন তান্ত্রিক, সাধকরা জড়িয়ে আছেন, তেমনই জড়িয়ে আছে ডাকত দল! কেবল তাঁরাই নন কালী উপাসনার সঙ্গে মিশে আছেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীরাও। তাঁরাও শক্তির আরাধনা করতেন। শাক্ত দেবীর আরাধনা করে স্বাধীনতার বীজমন্ত্রে দীক্ষিত হতেন। প্রতিজ্ঞা করতেন দেশ স্বাধীন করার। পরাধীন ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছেন দেবী কালী, বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের সাক্ষী বাঁকুড়ার কালীতলার কালীপুজো। যা বড় কালীর পুজো নামেও পরিচিত। দেবী এখানে মৃন্ময়ী, চতুর্ভুজা। দেবীর হাতে থাকে খড়গ। বড় কালীর পুজো হয় তান্ত্রিকমতে। পুজোর বয়স চারশো বছরের বেশি। সারা বছর দেবীর বেদিতে মায়ের খাড়া রেখে পুজো হয়।

বাঁকুড়া শহরের এই বড় কালীর আরাধনার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে যতীন দাস, বাঘা যতীন, ভগৎ সিং ও রাজগুরুর মতো ভারতের বীরসন্তানদের নাম। বড় কালীতলা মন্দিরের সামনেই রয়েছে প্রাচীন এক বৈপ্লবিক বাড়ি। ১৮৬৩ সালে মতান্তরে ১৮৮২ সালে বিশিষ্ট আইনজীবি হরিহর মুখোপাধ্যায় বাঁকুড়া শহরে বড় কালীতলায় একটি চুন সুড়কির তৈরি বাড়ি নির্মাণ করেন।

স্বাধীনতা আন্দোলন তখন মধ্যগগনে, বিংশ শতকের গোড়ায় স্থানীয় বাসিন্দা জনৈক রামদাস চক্রবর্তীর বাড়িতে গড়ে উঠেছিল বিপ্লবীদের গোপন ডেরা। বারীণ ঘোষ, প্রফুল্ল চাকিদের মতো বিপ্লবীরা আসতেন সেখানে। বিপ্লবীরা শক্তির আরাধনা করতেন এই বড় কালী মন্দিরে। প্রতিদিন দু-বেলা মন্দির চত্বরে বিপ্লবীরা শরীরচর্চা করতেন। কুস্তি, মুগুর ভাজা, যোগাসন চলত। কালীমন্দিরের আড়ালেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ করতেন বিপ্লবীরা। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গীতাপাঠ, শক্তি সাধনা ও বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা দেওয়ার কাজও হত মন্দিরে। বিপ্লবীরা কালীতলার কালীমন্দিরে কালী মূর্তির সামনে গীতা পড়তেন। ১৯০৮ সালে আলিপুর বোমা মামলায় জড়িত বিপ্লবীরা বলেছিলেন, বাঁকুড়ার কালী মন্দিরে তাঁকে গীতা পড়ে শপথ নিতে হয়েছিল।

জনশ্রুতি রয়েছে, জনৈক রঘু ডাকাত এই এলাকায় দেবীর উপাসনা শুরু করেছিলেন। জঙ্গলঘেরা এই এলাকা তখন ছিল জনশূন্য। এলাকায় ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বসতি। সেই পুজো আজও চলছে।

অগ্নিযুগের ইতিহাসকে মনে রেখে, আজও কার্তিক অমাবস্যায় কালীপুজোর দিন মন্দির সংলগ্ন মাঠে ঝোলানো হয় শামিয়ানা। রাতভর কালীর আরাধনা চলে। একদা এখানে শতাধিক বলি হত, এখনও বলির হাঁড়িকাঠ রয়েছে মন্দির চত্বরে। বাঁকুড়া জেলার প্রাচীন ও ঐতিহ্যমণ্ডিত কালী মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম বাঁকুড়া শহরের বড় কালীতলার মন্দির। বাঁকুড়া শহরের এই মা কালী বড় কালী নামেই পরিচিত। তবে মন্দিরে বিপ্লবীদের নিয়মিত যাতায়াত থাকার কারণে, দেবী কালীকে ‘বিপ্লবী কালী’ও বলেন কেউ কেউ। মন্দিরে বংশানুক্রমে পুজো করেন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা। আজও তাঁরাই মন্দিরের উপাসক।

বড় কালীতলা মন্দিরের সন্নিকটস্থ ‘বিপ্লবী’ বাড়ি থেকেই যাবতীয় বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ চলত। বাঁকুড়া শহরের ১২নম্বর ওয়ার্ডের বড় কালীতলা গার্লস হাইস্কুল সংলগ্ন এই বাড়ি বিপ্লবীদের আস্তানা ছিল। তৎকালীন সময়ে অনুশীলন সমিতির গোপন আস্তানা হিসেবেও এই বাড়ি ব্যবহৃত হত। অনুশীলন সমিতির বহু বিপ্লবীর আনাগোনা ছিল এই বাড়িতে। ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে, দিনের পর দিন এই বাড়িটিতে থাকতেন বিপ্লবীরা। বাড়ির ভিতরেই রয়েছে একটি গুপ্ত কক্ষ। সেখানে রাখা থাকত বিপ্লবীদের আগ্নেয়াস্ত্র। এ বাড়ির সদস্য ধরণীধর মুখোপাধ্যায় বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন, নিজেও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। বাড়ির উপর পুলিশেরও কড়া নজর থাকত। বাড়িতে পুলিশ ঢোকার আগেই মজুত করা অস্ত্র পিছনে একটি পুকুরে ফেলে দেওয়া হত, পুলিশ কিছুই টের পেত না। অবস্থানগত সুবিধার কারণে এখানে থেকেই স্বাধীনতার লড়াই চালাতেন বিপ্লবীদের।

স্থানীয়দের বিশ্বাস, মাকে ভক্তি ভরে ডাকলে ভক্তের মনস্কামনা পূরণ করেন দেবী বড় কালী। বিপদে, আপদে মাকে ডাকলে উদ্ধাররের পথ মেলে বলেই তাঁদের বিশ্বাস।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...