বাংলা নববর্ষ ও কলকাতার বাবু কালচার

উনিশ শতকের কলকাতায় ব্রিটিশ রাজের মধ্যেও মাথাচাড়া দিয়েছিল বাবু কালচার। বাবুদের অগাধ টাকা-কড়ি আর আমোদপ্রেম কার্যত কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গিয়েছে। উৎসব পেলেই তাঁরা মেতে উঠতেন। নববর্ষের কলকাতায় আমোদ-আল্লাদের জন্ম অনেকটা তাঁদের হাতেই। হুতোম বাংলা নববর্ষ উৎসব উদযাপনকে দু'টি পর্বে ভাগ করেছেন, একটি পর্ব নববাবুদের উৎসব পালনের বিষয়। ধর্মীয় পূর্ণকলস উৎসর্গের মতো নববাবুরা বছর শেষকে বিদায় এবং মদের কলসি উৎসর্গ করে বাগানবাড়িতে নববর্ষকে স্বাগত জানাত। অন্যটি, নেহাতই ব্যবসায়িক বা বাণিজ্যিক।

কালী সিংহী লিখে গিয়েছেন '‌ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আদর করেন। আগামীকে দাড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে ন্যান— নেশার খোঁয়ারির সঙ্গে পুরানোকে বিদায় দেন। বাঙ্গালীরা বছরটি ভাল রকমেই যাক্ আর খারাবেই শেষ হোক্‌, সজ্‌নেখাঁড়া চিবিয়ে, ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধূলো দিয়ে পুরানোকে বিদায় দেন। কেবল কল্‌সি উচ্ছুগ্‌গুকর্ত্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন!'‌

দ্বারকানাথ ঠাকুর, তাঁর বাগানবাড়িতে সাহেব ও মেমসাহেবদের নিমন্ত্রণ করে বাংলা নববর্ষ পালন করেছিলেন, সেই দৃষ্টান্তও ছড়িয়ে আছে কলকাতায়। সুস্বাদু খাবার, পাশ্চাত্য সঙ্গীত আর নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে নববর্ষের সন্ধ্যা মহাসমারোহে পালন করেছিলেন পরাধীন ভারতের রাজপুত্র।

নববর্ষের খাওয়া-দাওয়ায় সাবেকি বাঙালি ভোজের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি কিছু পদও থাকত। তবে সেই সব রান্না বেশিরভাগই বাঙালি আদব-কায়দায় রাঁধা হত। বনেদি বাঙালি বাড়ি বা বাবুদের বাড়িতে নয়া বছরের মেনুতে থাকত নানা রকম বাঙালি মিষ্টি আর শরবত। নোনতায় থাকত নিমকি, বাঙালি শিঙাড়া ইত্যাদি। দুপুরের খাবারের পাতে আমিষ ও নিরামিষ দু'ধরনের পদই থাকত। মেনু শুরু হত শাক আরও বিভিন্ন ধরনের ভাজা দিয়ে। এরপর আসত নিরামিষ পদ। সর্ষে, পোস্ত, ডাল, দুধ, বড়ি ইত্যাদি দিয়ে রাঁধা হত নিরামিষ পদ। মানকচুর মরিচ বাটা, মটরডালের পাটভাজা, ঝাল রসা, মটরডালের চচ্চড়ি, ছানা দিয়ে মুগডালের চিলোয়া, ছানার কাটলেট, পুঁটিমাছ করলা দিয়ে তেতো চচ্চড়ি, শিম বেগুন ট্যাংরার ঝাল, শোলমাছ ও মুলোর কালিয়া ইত্যাদিও থাকত। রুই মাছের টিকলি কালিয়া, ভাজা ঝালের চিংড়ি মাছ, চিতল গাদার জল বড়ার কালিয়া, নার্গিস কাবাব, গুলি কাবাব, মটন কাটলেট জাতীয় পদও রাঁধা হত। বিনস, গাজর, পেঁপে, আলু, পেঁয়াজ ও টোম্যাটো দিয়ে তৈরি হতো স্টু। ভাতের চল তেমন ছিল না, ঘি-ভাত গোছের পোলাও খাওয়া হত। ডেজার্টের মধ্যে থাকত লাউয়ের বরফি, মালপোয়া, আতার রাবড়ি, দুধ গাজরের হালুয়া, হরেক কিসিমের পুডিং।

কলকাতায় বাবুরা নববর্ষের বিশেষ দিনে কোঁচানো ধুতি চাদরে উৎসবের মেজাজে মেতে উঠতেন। আমন্ত্রিত থাকতেন বহু অতিথি। বাবুদের বৈঠকখানা সেজে উঠত। সঙ্গে প্রচুর খানাপিনার ব্যবস্থা থাকত। সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্ত বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে এক মহাভোজসভা বসিয়েছিলেন। শহরের তাবড় তাবড় 'বাবু' নিমন্ত্রিত ছিল সেখানে। হাটখোলার দত্তরা থেকে শুরু করে, জানবাজারের রানি রাসমণির জামাই মথুর বিশ্বাস, প্রসন্ন ঠাকুর, ব্রজমোহন সিংহ, শ্যামাচরণ সেন, ধর্মদাস পালিতরা সেখানে ছিলেন।

কলকাতার বাবুদের মধ্যে নববর্ষে আমোদ-আল্লাদের জন্য সবচেয়ে খ্যাতি ছিল গোকুলচন্দ্র মিত্র, ছাতু সিংহ, নীলমণি হালদার, রাজকৃষ্ণ প্রমুখদের। আড়ম্বর আর খানাপিনায় খরচ হত। কে, কাকে খরচের নিরিখে টেক্কা দেবেন! এই প্রতিযোগিতা চলত বাবুদের মধ্যে। নববর্ষে বাড়ির পুরনো ঝাড়বাতি সরিয়ে নতুন ঝাড়বাতি লাগানো হত। বাড়ি রঙ করাতেন বাবুরা।

বণিকদের মধ্যে রাজা সুখময় বাবুগিরিতে সব্বাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। নববর্ষে পোশাক, পরিচ্ছদে সর খানাপিনায় তিনি দরজা হাতে খরচ করতেন। কেবল নিজের জন্য নয় পরহিতেও মুক্ত হস্তে খরচ করতে কুন্ঠা বোধ করতে না। পয়লা বৈশাখে তিনি গরিব, দুঃখীদের দান করতেন। লুচি, মাংস, কোপ্তাকারী আর পাটালিগুড়ের পায়েস দিয়ে কাঙালি ভোজন করাতেন সুখময়। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত বাবু ছিলেন তনু বাবু। লোকে বলত বাবু তো বাবু তনু বাবু। মদন দত্তের বড় ছেলে, হাটখোলার দত্ত বাড়ি তনু দত্ত ব্যয়ের বিষয়ে ছিলেন দিলখোলা। দু-হাতে দান করতেন। ধুতির পাড় কেটে পরতেন, পাছে কোমরে দাগ না বসে। ঢাকা থেকে তাঁর নববর্ষের ধুতি আসত। পয়লা বৈশাখের দিন তাঁর প্রসাদোপম বাড়ি আতর দিয়ে মোছা হত। ইরানি আতর ও গোলাপ জল ধোয়া হত বাড়ি। রাতে ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় বাড়ি মুড়ে ফেলতেন তনু বাবু।

তনু দত্তের বাড়ির লোকেরা নববর্ষের দিন সোনা, রুপোর থালা, গ্লাস, বাটিতে খেতেন। ঘটা করে লোক খাওয়াতেন, ভোজসভায় কোনও বিভেদ করতেন না। দত্ত বাড়িতে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান সবাই আমন্ত্রিত থাকত। খাওয়াদাওয়ার পর গানবাজনা, রঙ্গ-তামাসার ব্যবস্থাও থাকত। তনু বাবু দরাজ হাতে দান করতেন। পয়লা বৈশাখে কেউ দান চাইলে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে একবারে যা উঠত, তাই-ই দিয়ে দিতেন তনু বাবু। বাবুদের বাবুয়ানি মিশে গিয়েছিল নতুন বছরের আমোদ-প্রমোদে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...