কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত জোড়াসাঁকোয় বিরাজ করেন দেবী কালী। স্থাননামেই মন্দিরের নামকরণ হয়েছে, জোড়াসাঁকো কালীবাড়ি। দাপ্তরিক তথ্য অনুযায়ী মন্দিরের বয়স প্রায় দুশো বছরের কাছাকাছি। তবে মনে করা হয় দেবী কালিকা আরও সুদীর্ঘ সময় যাবৎ এখানে পূজিতা হচ্ছেন। কলকাতার পোস্তা অঞ্চলে কালীকৃষ্ণ ঠাকুর স্ট্রিটে মন্দিরটি অবস্থিত। জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্র সরণি মোড়ে রয়েছে এই কালী মন্দিরটি। কলকাতা পুরসংস্থার রেকর্ড অনুযায়ী, ১৮৪০ সাল থেকে এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। মন্দিরের বর্তমান যে রূপ দেখা যায়, তা সংস্কার করা হয় ১৮৭৩ সালে।
জোড়াসাঁকো ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। তান্ত্রিকেরা এখানে দীর্ঘকাল কালী সাধনা করেছে। চিৎপুরের ডাকাতরাও দেবী কালিকার সাধনা করেছে। চিৎপুর থেকে কাশীপুর হয়ে কালীঘাট পর্যন্ত ছিল রাস্তা। ডাকাতদের ঘাঁটি ছিল। ডাকাতদের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে মা কালীর পুজো। সে সময়ে একটি বিশাল বটগাছের নীচে তারা মা কালীর আরাধনা করত। মায়ের পুজো করত ডাকাতরা। একদিন জনৈক শ্রীধর ভট্টাচার্য চিৎপুর রোড ধরে কালীঘাটে মায়ের মন্দির দর্শন করতে যাচ্ছিলেন। পথে ছিল ডাকাতদের কবলে পড়ার ভয়। ডাকাত আক্রমণের সম্ভাবনা। আশঙ্কা সত্যি হল। ডাকাত দলের পাল্লায় পড়লেন শ্রীধর ভট্টাচার্য। মা কালী ভক্তের সহায় হলেন। ডাকাতদের আচরণে অবাক হলেন শ্রীধর। ডাকাত সর্দার জানালেন তিনি গতরাতে মা ভবতারিণীর স্বপ্ন দেখেছেন। দেবী তাঁকে স্বপ্নে বলেছেন, তোর তো বয়স হয়ে গেল। এবার পুজোর ভার এক ব্রাহ্মণের হাতে ছেড়ে দে। আগামীকাল এক ব্রাহ্মাণ চিৎপুরের রাস্তা ধরে এই বটগাছের পাশ দিয়ে কালীঘাট মন্দির দর্শনে যাবে। তাঁকে স্বপ্নাদেশের কথা বলে পুজোর দায়িত্ব অর্পণ কর। শ্রীধর স্বপ্নাদেশের কথা শুনে আর দেরি করলেন না। পুজো করতে রাজি হয়ে গেলেন। জোড়াসাঁকোতে কালী মন্দির গড়ে মাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করলেন তিনি। সেই থেকে মায়ের পুজো শুরু হল। তারপর থেকে বংশ পরম্পরায় শ্রীধর ভট্টচার্যের উত্তরপুরুষরা মায়ের পুজো করে আসছেন।
দেবী দক্ষিনাকালী, তিনি ভবতারিণীর রূপ। শ্বেতপাথরের বেদীতে প্রতিষ্ঠিত দেবী কালিকা। শ্বেত সদাশিবের উপর দন্ডায়মান দেবী। কষ্টিপাথর নির্মিত মূর্তি। উচ্চতা ফুট দুয়েক। দেবী চতুর্ভুজা, তাঁর হাতে থাকে রৌপ্য খর্ড়্গ, নরমুণ্ড। দেবী সালঙ্কারা, সুবসনা, মাথায় থাকে রৌপ্যমুকুট, তার উপরে রৌপ্যছত্র। দেবীর জিহ্বা সোনার। মা ভবতাতিণীর মন্দিরের গর্ভগৃহে বিরাজ করেন। প্রতিদিন ভোর সাড়ে চারটের সময় শুরু হয় দেবী আরাধনা। নিত্যপুজো চলে। রাত সাড়ে নটায় দেবীর শয়নারতি করে মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয়। কার্তিক মাসে দীপান্বিতা অমাবস্যায় জাঁকজমকপূর্ণভাবে কালীপুজো হয়। দেবীকে বহুবিধ অলংকারে সাজানো হয়। কালীপুজোর পরদিন অর্থাৎ কার্তিকের কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদে অন্নকূট উৎসব আয়োজিত হয়। এই সময় বিপুল ভক্ত সমাগম হয়।
ভবতারিণী ছাড়াও মন্দিরে রয়েছেন নারায়ণ। চন্দ্রমৌলীশ্বর, নর্মদেশ্বর, অর্ধনারীশ্বর, স্ফটিক লিঙ্গ, পশুপতীশ্বর ও শিবলিঙ্গ; সব মিলিয়ে ছয় শিব ছয় মন্দিরে অধিষ্ঠিত। নারায়ণ শিলা থাকায় তাঁর জন্য আলাদা করে নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হত। প্রতি শনিবার গ্রহরাজ ও মা কালীর বিশেষ পুজো, যজ্ঞ এবং ভোগ নিবেদন করা হয়। মন্দিরে মহাসমারোহে দুর্গা পুজোর আয়োজন হয়। নবরাত্রিতে নয়দিন দেবীকে শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী এই নয় রুপে পুজো করা হয়। চৈত্রের নবরাত্রিতেও একই আয়োজন থাকে। চৈত্র এবং আশ্বিন মাসে শুক্লপক্ষের সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত মায়ের অন্নভোগ হয়। তাতে ভাত, ডাল, পঞ্চব্যঞ্জন, মাছের মুড়ো বা মাছ, পায়েস থাকে। নিত্যদিন ভক্তদের ভিড় উপচে পড়ে মন্দিরে।