কলকাতার এই বনেদি বাড়ির জমিদার ছিলেন ইংরেজদের ব্যাংকার

জোব চার্ণক ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার সুতানুটিতে এসেছিলেন। ‌ জায়গাটি ভারি পছন্দ হয়েছিল তাঁর। কোর্ট অফ ডিরেক্টরস-এর নির্দেশে ক্যাপ্টেন হিচের সঙ্গে ডিফেন্স নামে একটি জাহাজে তাকে যেতে হয়েছিল চট্টগ্রাম অভিযানে। সেই অভিযান ব্যর্থ হয়। জোব চার্ণক মাদ্রাজে আশ্রয় নেন। সেখানে প্রায় ১৫ মাস থাকার পর ১৬৯০ সালের জুলাইয়ে তিনি আবার সুতানুটিতে ফিরে এসেছিলেন। ১৬৯৩ সালে মারা যান জোব। তার পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ১৬৯৮ সালে ইংরেজরা কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানুটি গ্রামের জমিদারি স্বত্ব পেয়েছিলেন। 

 

কলকাতায় সেই সময় বাঙালি ব্যবসায়ী ও জমিদাররা রীতিমত রাজত্ব করছিল। অর্থ-কৌলিন্য এবং পরাক্রমের দিক দিয়ে তাঁরা ছিলেন অনন্য। এরকমই একটি নাম নকু ধর বা লক্ষীকান্ত ধর। এঁরা ছিলেন ইংরেজদের ব্যাংকার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে এঁদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নকু ধরের দৌহিত্র সুখময় রায় আজকের পোস্তা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।

 

নকু ধরের মেয়ের ঘরের সন্তান সুখময় রায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে এদের প্রচুর টাকা লেনদেনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শোনা যায় ইংরেজদের সঙ্গে  প্রথমবারের যুদ্ধে নকু ধর একসঙ্গে নয় লক্ষ টাকা ইংরেজদের ধার দিয়েছিলেন। নকু ধর জামাইকে ঘর জামাই করে রেখেছিলেন তিনি। সুখময় রায় ইংরেজদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করেছিলেন। ক্লাইভ নকু ধরকে ‘রাজা’ উপাধি দিতে চেয়েছিলেন। নকু ধর প্রত্যাখ্যান করেন। ক্লাইভকে বলেছিলেন "খেতাব যদি দিতে চাও আমার নাতিকেই দাও"।

 

বাংলার ইতিহাসে নকু ধরের একটা বড় ভূমিকা ছিল। শোনা যায়, নবকৃষ্ণ দেব একসময় চাকরির খোঁজে তাঁর দ্বারস্থ হয়েছিলেন । নকু ধর তাঁকে ওয়ারেন হেস্টিংস -এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। নবকৃষ্ণ হেস্টিংস-এর ফারসি শিক্ষক নিযুক্ত হন। কিন্তু বাংলার ইতিহাসে নকু ধরের নাম সেভাবে কেউ জানে না। যদিও পোস্তা রাজবাড়ি আজও রয়েছে। পোস্তার নাম এখন আলু পোস্তা। নানা মসলার বাজার এখানে। প্রাচীন পোস্তা রাজবাড়ির সামনের অংশটি মহর্ষি দেবেন্দ্র রোডকে জায়গা করে দিয়েছে। আগে এই রাস্তার নাম ছিল দরমাহাটা স্ট্রিট। স্বাধীনতার উত্তর কালে কলকাতাকে ঢেলে সাজাতে গিয়ে রাজবাড়ির সামনের কিছুটা অংশ ভাঙতে হয়। এই বাড়িটিকে মোট তিনটি বাড়ি হিসেবে ধরা হয়। লালবাড়ি, রাজবাড়ি, ঠাকুরবাড়ি। লালবাড়ি নামে অভিহিত প্রাসাদের সাবেকি স্থাপত্য কলা অনেকটাই রয়েছে। পোস্তা রাজবাড়ি আনুমানিক ১৯১১ সালে তৈরি হয়েছিল। এই রাজবাড়ির কাছে অবস্থিত কালাকার স্ট্রিট রাস্তাটি একসময় ঢাকা পট্টি হিসেবে পরিচিত ছিল। ঢাকা থেকে আগত সাহা পরিবাররা ওখানে থাকতেন। কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন এরা। সুখময় রায়ের পাঁচ ছেলে। মেজ ও চতুর্থ ছেলে অপুত্রক। বড় ছেলে রামচন্দ্র রায়ের পরিবারেই জোড়াসাঁকো রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিত হয়। সেজ ছেলের নাম রাজা বৈদ্যনাথ রায়। চিড়িয়া মোড়ে তাঁর বাড়ি। এঁরই বংশধর রাজা বিশ্বনাথ রায়।

 

নকু ধরের দৌহিত্র প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ একসময় ব্যাংকার এর কাজ করে এসেছেন। ব্রিটিশ আমলের আগে ভারতের নানা জায়গায় এদের অফিস ছিল। ব্যবসায়ীরা সেই সব অফিসে টাকা জমা রাখতেন। ব্রিটিশ আমলে এরা হয়েছেন জমিদার। রাজারহাট, তারকেশ্বর ও কলকাতায় এদের কয়েক হাজার বিঘা জমি ছিল। পোস্তা রাজবংশ কলকাতার অন্যতম বনেদি বাড়ি হিসেবে পরিচিত, আজও কলকাতার বুকে এই রাজবাড়ির ভগ্নাবশেষ টিকে রয়েছে।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...