কল্পবিজ্ঞান আর রহস্যের রোমাঞ্চে জয়ন্ত-মানিক জুটি

গোয়েন্দা কাহিনীর সঙ্গে খানিক অ্যাডভেঞ্চার বা রোমহর্ষক অভিযান মিশিয়ে দিলে যে রহস্য গল্পের জন্ম হয়, তা রূপকথারই সমান। সেখানে রহস্য উন্মোচন করা গোয়েন্দারা হলেন রাজকুমার, রহস্য অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত থেকে দুর্গমতার রাস্তা পেরিয়ে সেই রহস্য অবধি পৌঁছানোর পথটুকু যেন কোন পক্ষীরাজ ঘোড়া। আর রহস্য উন্মোচন করে পাঠককে সত্য পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া রাজকন্যা উদ্ধারের মতই খুশির আলোয় মোড়া অনুভূতি। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের রহস্য গল্পগুলো পাঠককে ঠিক এরকম অনুভূতির দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। হেমেন্দ্রকুমার রায়ই প্রথম বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা কাহিনীর সঙ্গে কল্পবিজ্ঞানের যোগসূত্র  ঘটান। বিদেশি রহস্য সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের প্রবেশ অনেককাল আগে। কিন্তু বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে হেমেন্দ্রকুমার রচিত গোয়েন্দা গল্পগুলোর আগে এ বিষয়ের উল্লেখ সেভাবে পাওয়া যায়না। তাঁর রচিত অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীগুলোর নায়ক বিমল-কুমার। গোয়েন্দা কাহিনীগুলোর সারথি জয়ন্ত-মানিক। প্রধানত শিশু-কিশোর সাহিত্য হলেও এই সৃষ্টির নিজস্ব প্রজ্ঞা, সরল ভাষা আর অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পাঠককে টানে। রহস্যের স্বাদে মুগ্ধ হয় পাঠক।

সাধারণত রহস্য উপন্যাস সৃষ্টির মূলে থাকে একজন গোয়েন্দা। বাকিরা তাঁর সহযোগী বা সহকারী। একজন গোয়েন্দা চরিত্রের মাধ্যমেই আমরা রহস্য কাহিনীগুলোকে চিহ্নিত করি। হেমেন্দ্রকুমার রায় সৃষ্ট গোয়েন্দা গল্পগুলোতে আমরা গোয়েন্দা চরিত্রদ্বয়কে পাই। সেখানে পাঠকের কাছে দুজনেই সমান ভাবে পরিচিত। লেখক তেমনভাবেই গড়ে তুলেছেন তাঁর সাহিত্যের নায়কদের। যেমন বিমল-কুমার জুটি, জয়ন্ত-মানিক জুটি।

বিমল ও কুমার বন্ধু। সাহসী, অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। দুঃসাহসিক অভিযানে পারদর্শী। অলৌকিক , অতিপ্রাকৃত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে তাঁরা। নানা বিপদ সংকুল পথে এগিয়ে চলেছে তাঁদের অভিযান। বিমল-কুমার এর কাহিনীগুলো মূলত অ্যাডভেঞ্চারধর্মী। কোনো অপরাধীকে ধরার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে রহস্যের উদ্ঘাটন। সে রহস্যে হয়তো অপরাধের ছোঁয়া নেই। তবে আছে অ্যাডভেঞ্চারের সোঁদা গন্ধ। কিছু গল্পে কোনো দুর্ঘটনার মাধ্যমেও রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। যার সমাধান হয়েছে বিমল-কুমারের দুঃসাহসিক বুদ্ধিতে। বিমল-কুমারের পুরনো ভৃত্য রামহরি এবং তাঁদের পোষ্য বাঘাও সঙ্গ দিয়েছে তাঁদের অ্যাডভেঞ্চারের জার্নিতে। অসম্ভব প্রজ্ঞাশীল মানুষ বিনয় বাবু এবং এক সাহসী বালক কমলও বিমল-কুমারের সঙ্গী হয়েছে কিছু কাহিনীতে।

জয়ন্ত-মানিকের গল্পগুলো প্রধানত গোয়েন্দা কাহিনী। জয়ন্ত মূল গোয়েন্দা এখানে, তাঁর শাগরেদ মানিক। দুজনেই একসঙ্গে থাকে। ভয়ডর নেই। জয়ন্তর বয়স একুশ-বাইশ। মানিক বয়সে একটু ছোট তাঁর থেকে। জয়ন্ত-মানিককেও আমরা জুটি হিসেবেই চিনি। তাঁদের সঙ্গে থাকেন পুলিশ অফিসার সুন্দর বাবু। সুন্দর বাবুর চরিত্রটি এই সাহিত্য কাহিনীগুলিতে কমিক রিলিফ। কিছু গল্পে জয়ন্ত-মানিক, বিমল-কুমারের দেখা হয়েছে। তাঁদের বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানে অনেক রহস্যই উদঘাটিত হয়েছে। হেমেন্দ্রকুমারের গল্পগুলি প্রকাশের সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে এই কাহিনীগুলি প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। বাংলা গোয়েন্দা গল্পের বিজ্ঞানের যথোপযুক্ত ব্যবহার প্রথম ঘটিয়েছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। 'জয়ন্তর কীর্তি'তে কল্পবিজ্ঞানের মাধ্যমে রহস্য সমাধান উল্লেখযোগ্য। বিজ্ঞানের সঠিক ব্যবহারে গোয়েন্দা কাহিনীগুলো হয়ে উঠেছে আরো শাণিত ও বিশ্বাসযোগ্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...