ভারতীয় স্পিনারকুলের ফাস্ট বোলার, শ্রীনাথ বহুরূপীকে চিনতে কেটেছে দশক

পৌরাণিক আদলে যাকে দেখছ দৈত‍্যকুলে প্রহ্লাদ, সে আসলে ভারতীয় স্পিনারকুলে ফাস্ট বোলার। ভয়ের চোখে যেটা বিদ‍্যুৎ, আগুন বা সাপের ছোবল। সেটা আসলে কারও হাতে নিতান্ত একটা বল। ক্রিকেট খেলাটাই বোধ হয় ছদ্মবেশের। ঠিক যেন বাঘ সাজা শ্রীনাথ বহুরূপী। 

১৯৯৬ ভারত বনাম শ্রীলঙ্কা সেই কলঙ্কিত সেমি ফাইনাল... কিন্তু দিনের শুরুটা বল হাতে একজন চমকপ্রদ শুরু করে আমাদের দেখিয়েছিলেন স্বপ্ন, শ্রীলংকা প্রথমে ব্যাট করতে এসে ১ রানে ২ উইকেট!প্যাভিলিয়নে ফেরৎ পাঠিয়েছেন কাদের? না ওই বিশ্বকাপে প্রতিপক্ষ বোলারদের ত্রাস জয়সূর্য এবং কালুভিথরনে!

এরপর ভারতের ব্যাটিংয়ের সময় শচীনের আউট হওয়ার পরে অবশিষ্ট ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা যদি সুইসাইড মোডে না চলে যেতেন, ভারতকে ফাইনালে তোলার জন্য হয়তো জাভাগাল শ্রীনাথের বন্দনায় মুখর হয়ে যেত ক্রিকেটদুনিয়া। 

বন্দনার আশা কোনোদিনই সেরম করেননি। কপিলের মতোই অধিকাংশ সময় ভারতীয় মরা পিচে বোলিং করে যেতে হয়েছে, আজহারউদ্দিন জমানায় টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে কুম্বলে, রাজুরা যতো না হাত ঘুরিয়েছেন, তার তুলনায় শ্রীনাথের ভাগ্যে জুটেছে নাম কা ওয়াস্তে কিছু ওভার! এর সঙ্গে রয়েছে তৎকালীন ভারতীয় দলের দুর্বল ফিল্ডিং, সমমানের কোনও বোলিং পার্টনারের অভাব এবং আজহারউদ্দিনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত রক্ষণাত্মক মানসিকতা, কতো টেস্টে তো গালি, থার্ড স্লিপ কিচ্ছু পাননি... অথচ এতোই নিপাট ভদ্র ফাস্ট বোলার যে মুখ ফুটে কোনদিন কিছুই বলে ওঠেন... ফিল্ডার ক্যাচ মিস করলে চুপচাপ আবার নিজের বোলিং মার্কে ফিরে যেতেন.. না কোনও স্লেজিং, না কোনও কিছু...

সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য জান উজাড় করে দিয়েছেন, প্রথম ভারতীয় ফাস্ট বোলার হিসাবে ওয়ানডেতে ৩০০ উইকেট, ১৯৯৬ সালে ভারতের নিষ্প্রাণ, ধুলোওড়া পিচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একুশ রানে ছয় উইকেট! তার মধ্যে আবার প্রথম ওভারেই হাডসন এবং কালিন্যানকে খাতা খোলার আগেই হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়ে!

সেই ম্যাচটা একবার ফিরে দেখা যাক। 

কুম্বলে তখন মধ‍্যগগনে।তাই শেষ ইনিংসে ওঁর বলেই বিপক্ষ ধরাশায়ী হবে,সেটা ভেবেই তৈরি হতো টেস্টের পিচ। আমেদাবাদ টেস্টেও ডোনাল্ডের দক্ষিণ আফ্রিকাও খেলেছিল দুই স্পিনার নিয়ে। তবে ওই টেস্টে ভারতের হারার সম্ভাবনাও ছিল যথেষ্ট। বলা যায় বেশিই। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকাকে জিততে হ'লে মাত্র ১৭০ করতে হত। কিন্তু ওরা দ্বিতীয়বার ব‍্যাট করতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল কুম্বলে নয়, শ্রীনাথের শিকারপর্ব। 

প্রথম ওভারেই পরপর দু'বলে আউট হাডসন আর কালিনান। তারপর ওঁর বল আরো মারাত্মক হয়ে উঠতে থাকে। ১০৫রানে ধসে যায় ক্রোনিয়ে ব্রিগেড। ২১রানে ৬উইকেট নিয়ে শ্রীনাথ প্রমাণ করেন উনি কপিলের যোগ‍্য উত্তরসূরী। এখানে বলা যায়,কপিলের বিশ্বরেকর্ডের(তৎকালীন সর্বাধিক টেস্ট উইকেট)দৌড় আর স্পিনারদের জন‍্য পিচ-এসবের জেরে দেশের মাটিতে কেরিয়ারের শুরুতে বেশ কয়েকটা বছর টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি শ্রীনাথ।তাই আমেদাবাদে ওঁর সেই চাপা ক্ষোভের আগুনে পুড়েছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা।ভারতের ম‍্যাচ উইনার বোলার যে আর এক কর্ণাটকীও সে-প্রমাণও মিলেছিল।

 ১৯৯৮ কলকাতা টেস্ট? মাইকেল স্লেটার, গ্রেগ ব্লিউওয়েটকে পরপর দুটি বলে ফেরত পাঠিয়ে পরে আবার মার্ক ওয়ার উইকেট, অস্ট্রেলিয়া একসময় হয়ে গিয়েছিল ১৫/৩! ৯৯ পাকিস্তানের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচটাও ভুলি কী করে? প্রথম ইনিংসে পাঁচটা, আবার দ্বিতীয় ইনিংসে আটটা শিকার!

সৌরভ অধিনায়ক হওয়ার পরে অনেক বুঝিয়ে শ্রীনাথকে ২০০৩ বিশ্বকাপ অব্দি খেলতে রাজি করিয়েছিলেন, শ্রীনাথ নিজেও স্বীকার করেছেন যে ক্যাপ্টেন ঐভাবে না বললে হয়তো আরও আগেই অবসর নিয়ে নিতেন, সৌরভ ভুল তো কিছু ছিলেন না, জাহির, নেহরাদের পথপ্রদর্শক সেইসময় শ্রীনাথের বাইরে কাউকে ভাবা যেত!

 ২০০৩ বিশ্বকাপেও বুড়ো হাড়ে ভেলকি তরুণ পেসারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। স্বয়ং ইমরান খান তাঁর প্রশংসা করেছেন, গ্রান্ট ফ্লাওয়ার বলেই দিয়েছিলেন সেরা সময়ে শ্রীনাথের বলের জোর হয়তো বা ক্যালিস, গিলেসপি, ম্যাকগ্রা এঁদের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। 

প্রকৃত টিমমেটের উদাহরণ তিনি! কুম্বলে যাতে দশ নম্বর উইকেটটা পেয়ে যান, তার জন্য শ্রীনাথ ওভারে ওয়াইড বল করে গিয়েছিলেন যাতে উইকেট না পড়ে তাঁর ওভারে.. ব্যাট হাতেও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওয়ানডেতে শ্রীনাথ আর কুম্বলের ঐতিহাসিক পঞ্চাশ রানের জুটি, দলের জন্য এতো অবদান রেখেও চিরকালের প্রচারবিমুখ! কেরিয়ারের মধুরেণ সমাপয়েৎটাও হয়ে যেত যদি ২০০৩ ফাইনালটা জিতে মাঠ ছাড়তেন। 

কিন্তু যা পেয়েছেন তাও যে কম নয়, ভারতীয় পেস বিভাগের দায়িত্ব কপিল দেবের অবসরের পরে অনেকটা সময় ধরেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে দেশে বিদেশে গ্যারি কার্স্টেন, মার্ক টেলর, কালিন্যান, আনোয়ার, ইজাজ আহমেদ প্রমুখ ব্যাটসম্যানদের গতি এবং রিভার্স সুইং এর মোহজালে পরাস্ত করা কী চাট্টিখানি কথা ছিল নাকী?

জন্মদিনে ভালো থাকবেন জাভাগল শ্রীনাথ। 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...