দুর্গাপুজোয়ও একসময় জারি গান গাওয়া হত

"শাহ আন্ত হুসেন বাদশা আন্ত হুসেন
দীন আন্ত হুসেন, পনহা আন্ত হুসেন
সারদাদ না দাদ দপ্তদর দন্তে ইয়াজিদ
হকক-ক-কে বীনা-লা-এলাহালা আন্ত সুয়ে"।

সুদূর আরবের কারবালা মরু প্রান্তরে হাসান-হোসেনের সঙ্গে এজিদ বাহিনির যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হাসান-হোসেনকে নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলা হয়। সেই করুণ কাহিনি গানে স্থান পায়। মুসলিম সম্প্রদায় মহরম পরবের সময় হাসান-হোসেনের শোকগাথা নৃত্য ও গীতের মাধ্যমে পরিবেশন করে। এই শোকগাথাই হল 'জারি গান'।

জারি গান ও নাচ সাধারণত মুসলিম পুরুষরাই পরিবেশন করে থাকেন। এই নৃত্য ও গানে মুসলিম মেয়েরা প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেন না। আসামের মিশমিশে, নাগা নৃত্যের সঙ্গে জারি নৃত্যের মিল অনেকে খুঁজে পান। তাঁদের মতে আদিবাসীদের বীর রসের জারি গান করুন রসে পরিবর্তিত হয়েছে। গুরুসদয় দত্ত তাঁর 'ফোক ড্যান্স অব বেঙ্গল' বইতে বলেছেন জারি গানের সঙ্গে সারি বা ভাটিয়ালি গানের সুরের মিল রয়েছে। তাঁর মতে নৌকা চালকদের ভাটিয়ালি ও সারিগান মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রভাবে করুণ রসের জারি গানে রূপান্তরিত হয়েছে।

বাংলাদেশের মৈমনসিংহে বিশেষত পূর্ব মৈমনসিংহে জারি গানের প্রচলন সর্বাধিক। পূর্ব-পশ্চিম বাংলাতেও জারি গান শোনা যায়। অঞ্চলভেদে জারি গানের গায়কির বিভিন্নতা রয়েছে। মুসলিম সমাজে মহরম উপলক্ষ্যে কারবালার শোকবহ গানই আসলে জারিগান।

ফার্সি 'যারী' শব্দ থেকে জারি কথাটি এসেছে। যার অর্থ আর্তনাদ, বিলাপ, শোক অর্থাৎ জারি গান হল বিলাপের গান। শোকের আর্তনাদ। ১৬৪৫ সালে কবি মুহম্মদ খান 'মকতুল হোসেন' নাম দিয়ে একটি শোকগাথা লিখেছিলেন। আশুরার সময় এই শোকগাথা পাঠ করা হত। এটি জারি গানের প্রথম নিদর্শন।

আশুরা মূলত শিয়া মুসলমানদের অনুষ্ঠান হলেও সুন্নি মুসলিমদের মধ্যেও প্রভাব পড়েছিল। ফলে জারি গান সুন্নিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আশুরার গল্পের পাশাপাশি আরব-পারস্য অঞ্চলের নানান কাহিনি জারিগানে শোনা যায়।

জহরনামা, সাদ্দাদের জারি, শাহজালালের জারি, সোহরাব-রোস্তমের জারি স্থানীয় কবিয়ালদের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। এঁরাই জারি গানকে লোকসঙ্গীতের আঙিনায় একটি বলিষ্ঠ জায়গা তৈরি করে দেয়।

জারি গানে দুটো দল থাকে। প্রতিদলে থাকে একজন করে বয়াতি বা মূল গায়ক। দুই জারি গানের দলের মধ্যে প্রশ্নোত্তর চলে তিনটে পর্বে। বন্দনা, গোষ্ঠগান আর মূল জারি গান। নারী-পুরুষ, আদম-শয়তান, জীবাত্মা-পরমাত্মা, রাম-হনুমান, গণতন্ত্র-রাজতন্ত্র, সুফি-মোল্লার মতো বিষয় সওয়াল আর জবাবের আকারে গাওয়া হয়। গানের শেষে কবিগানের মতো দুইদলের মধ্যে চাপান-উতোর হয়। এই অংশকে 'জেটকি' বলে।

মুসলিম তরুণেরা দশ-পনেরো জন মিলে একসঙ্গে নাচ ও গানের মাধ্যমে জারিগান করে থাকে। তাঁদের পরণে থাকে সাধারণত ধুতি, পায়জামা, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি। পাঞ্জাবির বদলে শিল্পীরা অনেক সময় কুর্তাও পরেন। শিল্পীর হাতে থাকে রুমাল। মূল গায়েন বা অন্য গায়েনরা সাধারণত ডান পায়ে জং বা ঘুঙুর পরেন। গান গাওয়ার সময় ডান হাতের রুমাল ঘুরিয়ে শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে ডান পায়ের জং-এ তাল দেয়। অনেক সময় দুই হাত দিয়ে বুকে জোরে জোরে চাপড় মেরে আর্তনাদের সঙ্গে গান পরিবেশিত হয়।

জারি গান মুসলিম ধর্মের কাহিনি ভিত্তিক হলেও তা ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে লোকসঙ্গীত নিজের জায়গা করে নিয়েছে। ধর্মীয় সঙ্গীতের অপরিবর্তনশীলতা অতিক্রম করে সামাজিক হয়ে উঠেছে। তাই একসময় এই গান দুর্গাপুজোতেও হতো বলে শোনা যায়। জারি গানই একমাত্র শোকগাথা যার মধ্যে করুণ ও বীররসের সমাহারের মেলবন্ধন ঘটেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...