সতীপীঠঃ মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পাহাড়ে একদা নররক্তে পূজিতা হতেন ‘দেবী মা জয়ন্তেশ্বরী’

মেঘের দেশ মেঘালয়। সেখানকার মোহিনী প্রকৃতির স্বর্গীয় সৌন্দর্যের টানে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক যেমন ছুটে যান; তেমনই অগণিত নিবেদিতপ্রাণ শাক্ত দেবী শক্তির অপার্থিব কৃপা অর্জন করতে এই রাজ্যে বার বার ছুটে আসেন। আসলে, এই রাজ্যের পশ্চিম জয়ন্তিয়া পার্বত্য জেলার নারটিয়াং নামক স্থানে রয়েছে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে পুজো হয়ে আসা এক সুপ্রাচীন শক্তিপীঠ তথা সতীপীঠ। কিংবদন্তি অনুসারে, ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে এখানে দেবী সতীর বাম ঊরু পতিত হয়েছিল। দেবী অঙ্গ সেই পৌরাণিককালে এখানে পতিত হওয়ার পর তা শিলায় পরিণত হয়। পরবর্তীকালে সেই স্থানে দেবীর থান গড়ে ওঠে এবং দেবী সর্বসাধারণের দ্বারা পূজিতা হতে শুরু করেন।

শিলং থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দেবীর এই থানটি জয়ন্তিয়া পাহাড়ের চূড়ায় রয়েছে। নীচ থেকে পাহাড় চূড়ায় দেবীর মন্দির অব্দি সুন্দর বাঁধানো সড়ক রয়েছে। সড়কের একদিকে পাহাড়ের গা, অন্যদিকে খাত। দু’দিক ঘেঁষেই শ্যামল অরণ্য। সড়ক বেয়ে চূড়ায় এসে মেলে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। এই প্রান্তরেই রয়েছে দেবীর মন্দির। তোরণ পেরোলে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। এই প্রাঙ্গণ সম্মুখে রেখেই খাসিয়াদের বাড়ির ধরণে নির্মিত হয়েছে মন্দির। টিনের দু’চালার লম্বা মন্দির, পিছনে একটি চূড়া। চালার রঙ রক্তলাল। সামনে মার্বেল পাথরে বাঁধানো বারান্দা। তাতে লম্বা লম্বা থাম। বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহের মেঝেও মার্বেলের তৈরি। গর্ভগৃহটি বেশ প্রশস্ত। শেষ প্রান্তে এক ফুট উচ্চতার বেদি। তাতেই রয়েছে দেবীর সিংহাসন।

দেবীর সিংহাসন ফুটখানেক উচ্চতাবিশিষ্ট। রত্নময় অলঙ্কৃত সেই সিংহাসনের ঠিক ওপরে সিলিং ঘেঁষে সুদৃশ্য চাঁদোয়া টাঙানো। চাঁদোয়ার নীচে রত্নময় ছত্র। সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা রয়েছেন সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা। দেবীমূর্তির উচ্চতা ইঞ্চি ছয়ের বেশি নয়। তাঁর সর্বাঙ্গ নকশা আঁকা অলঙ্কার ও বস্ত্রে সাজানো। দেবীর দশ হাত। তাতে নানাবিধ আয়ুধ। দেবীর আসন রক্তলাল ওড়নায় ঢাকা। দেবীর সর্বাঙ্গ নানা বর্ণের ফুল ও রক্তজবায় আবৃত। দেবীর সমগ্র মুখমণ্ডলে কোথাও ক্রোধ, হিংসার চিহ্নমাত্র নেই। এই দেবী আসলে মাতৃময়ী। তাঁর মুখে সেই মাতৃত্বের সুস্পষ্ট প্রকাশ রয়েছে। তাই ভক্তজন তাঁর চরণে এসে আশ্রয় পান, শান্তি পান; পান পরিপূর্ণ বাৎসল্যের স্বাদ। এই সতীপীঠে দেবী দুর্গারূপে আরাধিত হলেও দুর্গারূপে দৃশ্যমান হলেও সাধারণের কাছে তিনি স্থাননামে ‘জয়ন্তী’ বা ‘জয়ন্তেশ্বরী’ নামে পূজিতা হন।

দেবীর প্রাচীন থানে প্রথম মন্দির গড়ে ওঠে অনেক পরবর্তীকালে, আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে। মন্দির গড়ে দেন জয়ন্তিয়া বা জয়ন্তিয়াপুরের খাসিয়া রাজা ধনমাণিক্য। তাঁর আমলেই এই দেবী সাধারণের দরবার পেরিয়ে ওঠেন প্রাচীন জয়ন্তিয়া রাজ্যের অধীশ্বরী দেবী। সেটা কীভাবে হল, সে-কথাই এখন বলছিঃ

জয়ন্তিয়া রাজ্যটি ছিল খাসিয়াদের রাজ্য, খাসিয়া সংস্কৃতিরই বিস্তার ছিল সেখানে। রাজপরিবারও ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই এই সংস্কৃতির অনুগামী। প্রথম এই রাজবংশে হিন্দু সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে রাজা যশঃমাণিক্যের আমলে। তিনি বিয়ে করেছিলেন কোচবিহারের হিন্দুরাজা নরনারায়ণের কন্যা লক্ষ্মীকে। এই লক্ষ্মী ছিলেন অসম্ভব ধর্মানুরাগী এক নারী। ক্রমে ক্রমে তাঁর প্রভাবেই জয়ন্তিয়া রাজপরিবার হিন্দুধর্মের প্রতি মারাত্মক অনুরাগী হয়ে ওঠেন।

এরপর রাজা ধনমাণিক্যের আমলে এসে ধর্মানুরাগ অন্যমাত্রায় যায় এবং তা রাজনীতির অঙ্গ হয়ে ওঠে। তিনি নারটিয়াং-এর জয়ন্তিয়া পাহাড়ের মনোরম চূড়াকে তাঁর গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে মনস্থ করেন। সেটা আজ থেকে পাঁচশো বছর আগের কথা। তিনিই এই সময় প্রাচীন দেবীস্থানে দেবীর মন্দির গড়ে তোলেন। আসলে, দেবীর মন্দিরকে আশ্রয় করে আপন রাজধানী ও গ্রীষ্ম-আবাসের সুরক্ষার জন্য তিনি একটি ছদ্ম কেল্লা গড়ে তোলেন। সেখানে মজুত করেন অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র। পরবর্তীকালে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মন্দিরে স্থান পায় অসংখ্য কামান, বন্দুক ইত্যাদি। এমনটা আর কোন মন্দিরের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

যাই হোক, ধনমাণিক্য মন্দির তৈরি করে কেল্লার কথা গোপন রাখতে দেবীর আদেশের কথা প্রচার করলেন প্রজাদের মধ্যে। তাই-ই একদিন হয়ে উঠল কিংবদন্তি। এই কিংবদন্তি অনুসারে,  একদিন রাজা তাঁর গ্রীষ্ম-আবাসে থাকাকালীন দেবীর স্বপ্ন-আদেশ পান। দেবী তাঁকে স্বপ্নে আদেশ দেন প্রাচীন থানটিতে একটি মন্দির নির্মাণ করিয়ে বিধিবদ্ধভাবে পূজা প্রচলনের। রাজা ধনমাণিক্য দেবীর আদেশ পালন করেন। পুরোহিত পরম্পরা তৈরি করে দেবীর বিধিবদ্ধ পূজার প্রচলন করেন। দেবীর মন্দিরের পাশাপাশি তিনি মহাদেবেরও একটি মন্দির নির্মাণ করান। এই মহাদেবই হলেন দেবীর ভৈরব। বহুদিন আগেই রাজার তৈরি মন্দির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পরবর্তীতে তার ওপর গড়ে উঠেছে নতুন এক মন্দির। ফলত, এখন যে মন্দিরে ভক্তজন দেবীদর্শনে যান, তা অনেক পরবর্তীকালের তৈরি। তবুও তার কোনায় কোনায় পুরাতন ইতিহাসের ছোঁয়া রয়েছে। রয়েছে পুরানো কামান, বন্দুক, দেবীর ধাতুমূর্তি, দেবতাদের প্রস্তরমূর্তি।

এই দেবী ও তাঁর মন্দিরের একটি রোমহর্ষক ইতিহাস আছে। তার সঙ্গে যুক্ত আছে একটি প্রাচীন ঘৃণ্য ও অমানবিক প্রথা। আসলে, এই দেবী প্রাচীন সময়ে ও রাজ-আমলে নররক্তে পূজিতা হতেন। এই ঘৃণ্য প্রথা ইংরেজ রাজত্বের পূর্বকাল অব্দি টিকে ছিল। বধ্যভূমি ছিল গর্ভগৃহে। গর্ভগৃহে দেবীর সম্মুখে একটি কুণ্ড রয়েছে, এটিই সেই বধ্যভূমি। কাঠের পাটাতন দিয়ে বলির সময় ছাড়া এখন সেটি ঢাকা দেওয়া থাকে। এখান থেকে একটি সুড়ঙ্গ মন্দিরের পিছন দিয়ে নেমে পাহাড়ের নীচে বয়ে যাওয়া মুন্দু নদী পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। পূর্বে যখন কোন হতভাগ্য মানুষকে দেবীর নিকটে বলি দেওয়া হত, তখনই তার মাথা গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে পড়ত একেবারে নদীর জলে। খরস্রোতা এই নদীর ধারায় তক্ষুনি বয়ে যেত তা। ইংরেজ আমলে ব্রিটিশ কাউন্সিল আদেশ জারি করে এই বর্বর প্রথা বন্ধ করে দেয়। তখন নিয়ম করে দেবীর থানে ছাগল বলি দেওয়া শুরু হয়। ছাগলকে বলির সময় মানুষের পরিবর্ত হিসেবে দেখানোর জন্য তার মুখে মানুষের মুখোশ ও কোমরে ধুতি পরিয়ে দেওয়ার রীতি তৈরি হয়। এই রীতি এখনও বয়ে চলেছে।

দেবীর নতুন মন্দিরে এবং মন্দিরপ্রাঙ্গণের ইতিউতি ছড়িয়ে আছে প্রাচীন জয়ন্তিয়া রাজপরিবারের তৈরি মন্দিরের নানান অংশের ভগ্নস্তূপ, কারুকার্যখচিত স্তম্ভ, মূর্তি প্রভৃতি। আর আছে মন্দিরের সন্নিকটেই অদ্ভুত এক উদ্যান। সেই উদ্যানে একের পর এক বিরাট বিরাট পাথর খাড়াভাবে পিলারের মতো পোঁতা রয়েছে। এগুলোকে ইংরিজিতে ‘মনোলিথ’ বলে। এগুলো আসলে সেই জয়ন্তিয়া রাজাদের স্মৃতিস্তম্ভ। মনোলিথ উদ্যান পেরিয়ে গেলেই চোখে পড়ে রাজপ্রাসাদের ভগ্নস্তূপ। দেখলেই বোঝা যায়, প্রাসাদটি ছিল ইটের তৈরি। ভগ্নস্তূপ দেখে অনুমান করা যায় যে, তা ছিল বিশালকায়; কিন্তু তার সৌন্দর্য কতটা অপরূপ ছিল, তা আজ আর অনুমান করা যায় না।

এই মন্দিরের প্রধান উৎসব দুর্গা পুজো। এই পুজোর সময় বাংলায় যেভাবে কলাবউ সাজানো হয়, পুজো করা হয়; সেভাবে এখানেও কলাগাছের অঙ্গে শাড়ি পরিয়ে দেবী হিসেবে পুজো করা হয়। চারদিনের শারদীয়া উৎসব শেষ হলে খুব ধুমধামের সঙ্গে কলাবউকে শোভাযাত্রা সহকারে মুন্দু নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে দেবীকে রাজ-আমলের পুরনো বন্দুক চালিয়ে গান-স্যালুট দেওয়া হয়। এই শারদীয়া পুজো উপলক্ষে প্রতিদিন দেবীর থানে ছাগল, মুরগি ও হাঁস বলি দেওয়া হয়। এই উৎসবের জাঁকজমক এতটাই বর্ণাঢ্য যে, এতটাই রাজকীয় মর্যাদাময় যে; তা উদযাপনের প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে সারা ভারতের অসংখ্য শাক্তভক্ত এই মন্দিরে এই সময় ভিড় করেন; ভিড় করেন দেবীর শারদীয়া কৃপা বরণ করে ধন্য হতে।...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...