দেশবাসীর ভরসা কর্ণাটকের পতাকা গ্রাম

২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস। জানুয়ারি মাঝ মাসে পৌঁছলেই দেশ জুড়ে শুরু হয়ে যায় উন্মাদনা। ১৫ আগস্ট আর ২৬ জানুয়ারি এই দুই দিন প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ। দিল্লির লালকেল্লা, প্রগতি ময়দান থেকে পাড়ার স্কুলের খেলার মাঠ সব মিলেমিশে অনুভূত হয় একটাই অনুভূতি- দেশ এক। আমরা এক।

এই দুই দিন কাছাকাছি এলে নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকে না কর্ণাটকের বাগালকোট জেলার তুলাসিগেরি গ্রামের মহিলাদের। ভোর থাকতে উঠে ঘর-সংসারের কাজ সেরে বেরিয়ে পড়েন তাঁরা। আসেন গ্রামের খাদি গ্রামোদ্যোগ সংযুক্ত সংঘের ইউনিটে। ফ্যাক্টরিতে পা দেওয়া মাত্র শুরু হয়ে যায় প্রবল ব্যস্ততা।এক মুহূর্ত থেমে থাকে না তাঁদের হাত। চলতে থাকে চরকা আর সেলাই মেশিন। এই গ্রামেই যে তৈরি হয়। ভারতের তেরঙ্গা। শৌর্যের তেরঙ্গা। সাহসের তেরঙ্গা।৩:২ মাপের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকা। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে আম জনতার বাড়ির ছাদ সব জায়গায় উড়তে থাকে। 

গেরুয়া, সবুজ, সাদা তিন-রঙা এই পতাকা দেশবাসীর বিশ্বাস, ভরসা আর অস্তিত্বের প্রতীক। দেশ মাতৃকার সম্মান। সে পতাকা দেখলেই হৃদয় জুড়ে জন্মভূমির টান।

IMG-20240125-WA0107

উত্তর কর্ণাটকের ধরওয়াদ ও বাগালকোট জেলার নিকটস্থ গদগের দুটি তাঁত ইউনিটে খাদি বোনেন মহিলারা। এখন হুবলি-ভিত্তিক কর্ণাটক খাদি গ্রামোদ্যোগ সংযুক্ত সংঘ ভারতের একমাত্র লাইসেন্স-প্রাপ্ত জাতীয় পতাকা উৎপাদন ও সরবরাহ ইউনিট। খাদি উন্নয়ন ও গ্রামীণ শিল্প কমিশন (কেভিআইসি) ভারতে পতাকা উৎপাদন ইউনিট স্থাপনের জন্য অনুমতি প্রদান করে। তবে বিনির্দেশ অগ্রাহ্য করা হলে বিএসআই অনুমতিপ্রাপ্ত সংস্থার অনুমতি বাতিল করে দিতে পারে।

এই সমস্ত ইউনিটে কাজ করেন মহিলারা। পতাকা তৈরির কাজ সহজ নয়। হতে হবে একেবারে নিখুঁত। নয়টি আকারে ছয়টি ধাপে তৈরি হয় পতাকা।

পতাকা উৎপাদনের জন্য একমাত্র খাদি নামক হস্তচালিত তাঁতবস্ত্রই ব্যবহার করা যায়। তুলা, রেশম ও উল ছাড়া অন্যকিছু খাদির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। পতাকা উৎপাদনে দুই ধরনের খাদি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

প্রথমটি হল খাদি-বান্টিং, যা দিয়ে পতাকার মূল অংশটি প্রস্তুত করা হয় এবং দ্বিতীয়টি হল হালকা বাদামি রঙের খাদি-ডাক বস্ত্রখণ্ড, যেটি পতাকাকে পতাকাদণ্ডের রজ্জুর সঙ্গে ধরে রাখে। খাদি-ডাক এক অপ্রচলিত বয়নপদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে তিনটি সুতো একত্রে জালের আকারে বোনা হয়।

উল্লেখ্য, প্রচলিত বয়নপদ্ধতিতে দুটি সুতোকে একসঙ্গে বোনা হয়ে থাকে। খাদি-ডাক অত্যন্ত দুর্লভ এক বয়নপদ্ধতি। ভারতে এক ডজনেরও কম বয়নশিল্পী এই ধরনের বয়নে সক্ষম। নির্দেশিকায় আরো বলা হয়েছে, প্রতি সেন্টিমিটারে ১৫০টি সুতোর বেশি বা কম থাকবে না, প্রতি সেলাইয়ে চারটি করে সুতো থাকবে এবং এক বর্গফুট পতাকার ওজন ২৫ গ্রামের বেশি বা কম হবে না।

আঠারো বার গুণমান পরীক্ষায় পাশ করতে হয়। পতাকা উৎপাদনে কোনো খুঁত রাখা আইনত অপরাধ; এবং তার শাস্তি জেল, জরিমানা অথবা দুইই হতে পারে। বোনার পর পতাকার উপাদানগুলি বিএসআই ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। বিনির্দেশ অনুযায়ী পরীক্ষার পর যদি উপাদানগুলি উত্তীর্ণ হয়, তবেই সেগুলিকে ফ্যাক্টরিতে ফেরত পাঠানো হয়। তারপর নির্ধারিত রঙে এগুলিকে ব্লিচ ও ডাই করা হয়। কেন্দ্রের অশোকচক্রটি হয় স্ক্রিন প্রিন্ট, অথবা স্টেনসিল বা যথাযথ বয়নের মাধ্যমে খচিত করা হয়। অশোকচক্র অত্যন্ত সযত্নে পতাকায় আঁকা হয়, যাতে পতাকার দুই দিক থেকেই সেটি দেখা যেতে পারে। বিএসআই তারপর রং পরীক্ষা করে; এবং তারপরেই পতাকা বিক্রি করা যায়।

খাদি গ্রামোদ্যোগ সংযুক্ত সংঘ ভারতের একমাত্র লাইসেন্স-প্রাপ্ত জাতীয় পতাকা উৎপাদন ও সরবরাহ ইউনিট। ভারতের কর্ণাটকের ধারওয়াদ জেলার হুবলি শহরের বেঙ্গেরিতে সংস্থার সদর দফতর। ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস দ্বারা অনুমোদিত।

১৯৫৭তে স্বাধীনতা সংগ্রামী ভেঙ্কটেশ মাগাড়ি এই সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সন্নিকটস্থ অঞ্চলের বেশ কিছু খাদি উৎপাদক তাঁতিদের তিনি এক ছাতার তলায় নিয়ে আসেন এই উদ্যোগের মাধ্যমে। ২০০৫ সাল থেকে তুলাসিগেরি গ্রামে সরকারি অনুমোদনে তেরঙ্গা উৎপাদন শুরু হয়। ভারত সরকারের বিভিন্ন কার্যালয়ের জন্য পতাকা তৈরি করেন গ্রামের পিছিয়ে পড়া মহিলারা।

বেঙ্গালুরু বা কর্ণাটকের হাম্পি বেড়াতে গেলে অনেকেই হাবলি বা হাব্বাল্লি গ্রাম থেকে ঘুরে আসেন। বেঙ্গালুরু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র ৭ ঘন্টার জার্নি।   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...