কেমন ছিল সেকালের কলকাতার বড় পার্বণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার ঝুলন

শ্রাবণ পূর্ণিমা ঝুলন পূর্ণিমা নামে পরিচিত। ঝুলন রাধাকৃষ্ণের প্রেমের উৎসব। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, দ্বাপর যুগে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে কেন্দ্র করে বৃন্দাবন ধামে ঝুলন যাত্রার সূচনা হয়। ঝুলন শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে শুরু হয়ে পূর্ণিমা তিথিতে শেষ হয়। সব মিলিয়ে চার-পাঁচ দিনের উৎসব। কৃষ্ণপ্রেম, ভক্তিবাদ পেরিয়ে বাংলায় ঝুলন হয়ে উঠেছে লৌকিক উৎসব। কচিকাঁচাদের উৎসব। মাটির পুতুল দিয়ে ঝুলন সাজানোই এই উৎসবের মূল আকর্ষণ। কলকাতার বাবু শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা ঝুলনকে প্রভাবিত করেছিল। সেকালের কলকাতার অন্যতম বড় পার্বণ হয়ে উঠেছিল ঝুলন। বাংলা তথা কলকাতার ঝুলন উৎসবের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। বনেদিবাড়ি, মঠ, মন্দিরে এই উৎসব হয়। উত্তর কলকাতায় চালতা বাগান বিবেকানন্দ রোডের ঝুলন বাড়ি, বাগবাজারের হরি সাহার বাড়ি, বাগবাজার গৌড়ীয় মঠ, কুমোরটুলিতে গোকুলচন্দ্র মিত্র প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন মন্দির, ইসকন কলকাতা, লেবুতলা পার্কের চন্দ্র সূর্য বাড়ির ঝুলন বিখ্যাত।

 

কলকাতার ঝুলনের কথা বললেই এসে পড়ে ২৮ নম্বর বাবুরাম শীল লেনে অবস্থিত ‘ঝুলনবাড়ি’র কথা। বউবাজারের রামকানাই অধিকারীর বাড়ি ঝুলন বাড়ি নামেই পরিচিত। প্রায় ২০০ বছর আগে এই পরিবারের আদিপুরুষ কৃষ্ণমোহন অধিকারী ঝুলন উৎসবের প্রচলন করেন। তাঁর পৌত্র রামকানাই অধিকারীর আমলে ঝুলন উৎসবে আরও জাঁকজমক বেড়ে যায়। এই বাড়ির ঠাকুর দালানে রাধাকৃষ্ণ, গৌরনিতাই, জগন্নাথদেব ও লক্ষ্মীদেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। কৃষ্ণবিগ্রহ কষ্টিপাথরে এবং শ্রীরাধার মূর্তিটি অষ্টধাতু নির্মিত। এ বাড়িতে ঝুলন উৎসব হয় পাঁচ দিন ধরে। পাঁচ দিনে দেবতাকে বিভিন্ন বেশে সাজানো হয়। প্রথম দিন রাখাল বেশ, দ্বিতীয় দিন যোগী বেশ, তৃতীয় দিনে সুবল বেশ, চতুর্থ দিনে হয় কোটাল বেশ এবং শেষ দিনে রাজ বেশ। দেবতাকে এক এক দিন এক এক রকম ভোগ নিবেদন করা হয়। 

 

মধ্য কলকাতার ৩ নম্বর ক্রাউচ লেনে রয়েছে বলাই দাসের ঠাকুরবাড়ি। এদের বাড়ির ঝুলনও শতবর্ষের বেশি প্রাচীন। রাধাকৃষ্ণর পাশাপাশি জগন্নাথদেবও ঠাকুরবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত। উত্তর কলকাতার চালতাবাগানে বিনোদ সাহা লেনে বঙ্কুবিহারী সাহা প্রতিষ্ঠিত রাধাকৃষ্ণের ঝুলন মন্দিরে মহাসমারোহে ঝুলনযাত্রা উদযাপিত হয়। বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। কাছেই মণ্ডল পরিবারের রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে ঝুলন উৎসব হয়। একাদশী থেকে দ্বিতীয়া পর্যন্ত সাত দিন ধরে চলে ঝুলন। সাত দিনে সাত বেশ, প্রথম দিন রাধাকৃষ্ণের যুগল বেশ, দ্বিতীয় দিনে অনন্ত দর্শন, তৃতীয় দিনে রাসলীলা, চতুর্থ দিনে নৌকাবিলাস, পঞ্চম দিনে চন্দ্রাবলীকুঞ্জ, ষষ্ঠ দিনে রাইরাজা এবং সপ্তম দিনে মিলন বেশ। ঝুলন উপলক্ষে মেলাও বসে। দাসবাড়ির ঝুলনযাত্রার বিশেষত্ব হল এখানে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের সঙ্গে অষ্টসখীও স্থান পান। 

 

কলকাতার বউবাজারের বাঞ্ছারাম অক্রুর দত্ত লেনের ‘শ্রীমন্ত ভিলা’য় সাড়ম্বরে ঝুলনযাত্রা পালিত হয়। ১৯৩৫ সালে বারান্দায় পুতুল সাজিয়ে শুরু হয়েছিল ঝুলন। শ্রীমন্তের ভ্রাতুষ্পুত্র চন্দন পণ্ডিত ঝুলন উৎসব শুরু করেছিলেন। এ বছর শ্রীমন্ত ভিলার নব্বই বছরে পড়ল। কূলদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দনকে ঘিরেই এই উৎসব চলে। শ্রীমন্ত পণ্ডিতের ছেলে চন্দন পণ্ডিত ঝুলন যাত্রায় এনেছেন অভিনবত্ব। এনেছেন আধুনিকতার ছোঁয়া। পর্দায় আলো ফেলে সূর্য সূর্যোদয় ও চন্দ্রোদয়ের দৃশ্যায়ন এই বাড়ির ঝুলনযাত্রা কে অন্য মাত্রা যোগ করেছে। শ্রীমন্ত ভিলা চাঁদ-সূর্য বাড়ি হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। পুতুল আর তার সঙ্গে উপরি পাওনা বলতে আলো-আঁধারির খেলা। 

 

এছাড়াও শশিভূষণ দে স্ট্রিটের গৌরাঙ্গ মন্দিরের ঝুলনযাত্রা ১৫০ বছরেরও বেশী প্রাচীন। মুখোপাধ্যায় পরিবার এখনও ঝুলন উৎসবের আয়োজন করে। রাধারমণ ধর ঠাকুরবাড়িতে ১৮৮৭ সাল থেকে ঝুলন উৎসব পালিত হয়ে আসছে। দক্ষিন কলকাতায় প্রচীন গৌড়ীয় মঠে ঝুলন উৎসব হয়। দক্ষিণ কলকাতার বড় রাসবাড়তে অর্থাৎ টালিগঞ্জ রোডে বাওয়ালির মণ্ডল পরিবারের উদয়নারায়ণ মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন মন্দিরে আজও ঝুলন উৎসব পালিত হয়। এখানে ঝুলন মানে তিন দিনের উৎসব। প্রতি দিন ভোরে দেবতাকে ডাবের জল দিয়ে স্নান করানো হয় তারপর নতুন বেশে সাজানো হয়।

 

কালীর শহর কলকাতাতেও কৃষ্ণপ্রেমের অন্ত নেই। কলকাতার বনেদি পরিবারগুলোর অধিকাংশের কূলদেবতা আদপে রাধা-কৃষ্ণ। তবে নামের ফারাক রয়েছে কোনও পরিবারে শ্যামরাই, কোথাও আবার রাধাবল্লভ, কোনও পরিবারের গোপীনাথ আবার কোনও বাড়িতে রাধাগোবিন্দ। এঁদের ঘিরেই আবর্তিত হত পরিবারগুলোর উৎসব। দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, রাসযাত্রা ইত্যাদি। এভাবেই কলকাতায় ঝুলনযাত্রা মিশে গিয়েছে বনেদিয়ানা, বাবুগিরি আর ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...