ডাকটিকিটে সীতাভোগ-মিহিদানা

আহারের বাহারে বাঙালিদের কোনও জবাব নেই। তিতে দিয়ে শুরু করে টক হয়ে মিষ্টিতে শেষ হয় আমাদের খানা। পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যালেন্সড ডায়েট বোধহয় আমাদেরই। এই বাঙালি খানার একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে মিষ্টি। রকমফেরে যার শেষ নেই। পশ্চিমবাংলার মিষ্টির মানচিত্র আঁকতে বসলে, বেশ বেগ পেতে হবে। কারণ একেকটি জেলা একাধিক মিষ্টির জন্মস্থান।

 

আরে স্বাদে, যাকে বলে এক সে বড় কার এক! কোনও কোনও জেলার নাম তো মিষ্টির জন্যেই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। যেমন বর্ধমান বলতেই আমাদের মনে পড়ে সীতাভোগ-মিহিদানার কথা। বর্ধমান শহরের কথা বললেই এসে যাবে মিহিদানা আর সীতাভোগের কথা। বর্ধমান মিষ্টির জেলা, এ জেলার ল্যাংচাও জগৎ বিখ্যাত। তবে বর্ধমানের খ্যাতি মূলত এই দুই মিষ্টান্নকে ঘিরেই। সীতাভোগ এবং মিহিদানা। এবার সেই দুই মানিকজোড় এক জাতীয় সম্মান পেল।

seetabhog1

ভারতের ডাকবিভাগের স্ট্যাম্পে এবার দেখা যাবে সীতাভোগ এবং মিহিদানার ছবি। গত মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়েছে সেই কভারের। সীতাভোগ ও মিহিদানার ইতিহাস বর্ধমান শহরের মতো প্রাচীন নয় ঠিকই, কিন্তু এই মিষ্টির বয়স শতাব্দী প্রাচীন। ১৯০৪ সালে, বঙ্গভঙ্গের ঠিক প্রাকমুহূর্তে জন্ম হয়েছিল এই মিষ্টি। বর্ধমানের জমিদার তখন বিজয়চাঁদ রায় মহতাব। তাঁকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করার জন্যে শহরে আসবেন খোদ বড়লাট কার্জন। কার্জনকে অভ্যর্থনা জানাতেই বিজয়চাঁদ বানালেন বিরাট একটি গেট। যা এখন আমরা কার্জন গেট নামে চিনি।

 

কিন্তু কার্জনকে স্বাগত জানানোর আয়োজন যখন প্রায় শেষ, তখন জমিদারের মনে হয় বড়লাটকে মিষ্টিমুখ করানোর কথা। সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ে মোদক ভৈরবচন্দ্র নাগের। তিনিই তৈরি করলেন দুটি নতুন ধরনের মিষ্টান্ন। একটি চালগুঁড়ো ও ছানার মিশ্রণকে রসে ফেলে বানানো সীতাভোগ। আর অন্যটি মতিচুরের পদ্ধতিকেই বদলে নিয়ে তৈরি মিহিদানা। ১৯০৪ সালের ১৯শে আগস্ট লর্ড কার্জন বর্ধমানে আসেন। লর্ড কার্জনকে স্বাগত জানাতে ভৈরবচন্দ্র তৈরী করে রেখেছিলেন সীতাভোগ এবং মিহিদানা। যা খেয়ে অভিভূত হয়ে পড়েন কার্জন। মিষ্টি খেয়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন বড়োলাট যে, সমস্ত সরকারি অনুষ্ঠানে এই দুই মিষ্টি বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন।

seetabhog2

এরপর অবশ্য ইতিহাসে অনেককিছু ঘটে গিয়েছে। মহারাজা উপাধি পেয়েও স্বদেশিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন বিজয়চাঁদ। কিন্তু যা বদল হয়নি মিহিদানা এবং সীতাভোগের। এক ইঞ্চি ভাঁটা পড়েনি তাদের জনপ্রিয়তায়। ভারতীয় ডাকবিভাগের পক্ষ থেকে সেই ঐতিহ্যকেই তুলে ধরা হল এবার। কাভার প্রকাশের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণবঙ্গ রিজিয়নের পোস্টমাস্টার জেনারেল শশী সালিনি কুজুর, বর্ধমান ডিভিশনের সিনিয়র সুপারিন্টেডেন্ট অফ পোস্ট সৈয়দ ফরজ হায়দার নবি, বর্ধমান সীতাভোগ-মিহিদানা ট্রেডার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রমোদ কুমার সিং প্রমুখ। ১৫০ বছরের ঐতিহ্যশালী ভারতীয় ডাক বিভাগ দেশের নানা প্রান্তের ইতিহাসকেই ধরে রাখার চেষ্টা করে ডাকটিকিটের মাধ্যমে।

 

সীতাভোগ এবং মিহিদানা, বর্ধমান তথা বাংলার ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়। এই দুই মিষ্টির জনপ্রিয়তা ইতিমধ্যেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। এবার থেকে এই ডাকটিকিটের মাধ্যমে, বর্ধমান শহর ও তার বিখ্যাত এই দুই মানিকজোড়ের নাম আরও উজ্জ্বল হবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সুকুমার রায়, তাঁর পাগলাদাশুর চিনেপটকা গল্পে লিখেছিলেন, “হাঁড়িতে কী রেখেছিলি? রমাপদ তখন বুঝিতে পারিল যে গোলমালের জন্য সমস্ত দোষ তাহারই ঘাড়ে আসিয়া পড়িতেছে। সে বেচারা তড়িঘড়ি বুঝাইতে গেল, আজ্ঞে, ওর মধ্যে মিহিদানা এনেছিলাম, তারপর – মুখের কথা শেষ না হইতেই পন্ডিতমশাই বলিলেন, তারপর মিহিদানা গুলো চিনেপটকা হয়ে ফুটিতে লাগিল না? বলিয়াই ঠাস ঠাস করিয়া দুই চড়!"– বেচারা মিহিদানার কারনে আমরা পন্ডিতমশাই এর কাছে তাকে মার খেতে হয়েছিল। আজ সেই মিহিদানাই বর্ধমানবাসীর গর্ব। ২০১৭ সালের ৩১ শে মার্চ বর্ধমান সীতাভোগ এবং মিহিদানার জন্য ভৌগোলিক স্বত্বাধিকার লাভ করে।

seetabhog3

জন্ম হওয়ার এক বছরের মধ্যেই মিহিদানা এতটাই বিখ্যাত হয়ে যায় যে রজনীকান্ত সেন ১৯০৫ সালে প্রকাশিত, তাঁর কল্যানী কাব্যগ্রন্থের ঔদারিক সঙ্গীতে মিহিদানার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, “যদি কুমড়োর মতো, চালে ধরে রত,
পানতোয়া শত শত; 
আর সরষের মতো হত মিহিদানা,
বুঁদিয়া বুটের মতো।”

 

মিহিদানার প্রধান উপাদান হল চাল, এটি প্রস্তুতিতে সাধারণত গোবিন্দভোগ, কামিনীবোগ; নিদেনপক্ষে বাসমতী চাল ব্যবহার করা হয়। চালগুড়ো, বেসন, জাফরান প্রভৃতি মিশিয়ে একটি থকথকে মিশ্রন তৈরী করা হয়। একটি ছিদ্রযুক্ত পিতলের পাত্র থেকে সেই মিশ্রন কড়াইতে ফুটন্ত গাওয়া ঘিয়ে ফেলে কড়া করে ভাজা হয়। দানাগুলিকে ঘন চিনির রসে চুবিয়ে, ছেঁকে তুলে নিলেই তৈরী হয়ে যায় মিহিদানা।

seetabhog4

সীতাভোগ খেয়ে কার্জন এতটাই প্রীত হয়েছিলেন যে, তিনি সমস্ত সরকারী অনুষ্ঠানে সীতাভোগ পরিবেশন করা বাধ্যতামূলক করে দেন। সীতাভোগের অন্যতম প্রধান উপাদান সুগন্ধী চাল সীতাস, বর্ধমান জেলার একটি বিশেষ অঞ্চলে উৎপাদিত হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, চালের নাম থেকেই মিষ্টির এইরূপ নামকরণ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট অনুপাতে ঐ চাল গুঁড়ো ও ছানা মিশিয়ে বাসমতী চালের আকৃতির মতো ছিদ্রযুক্ত পিতলের পাত্র থেকে উক্ত মিশ্রনকে গরম চিনির রসে ফেলা হয়। এই কারনে সীতাভোগ দেখতে, রঙ ও আকৃতিতে ভাতের মতোই হয়। ছোট ছোট নিখূঁতি, কাজু, কিসমিস ও চেরী সহযোগে সীতাভোগ ও মিহিদানা যুগ যুগ ধরে পরিবেশিত হয়ে আসছে। বর্ধমানের প্রায় সমার্থক হয়ে গিয়েছে এই দুই মানিকজোড়।
বিখ্যাত হাস্যকৌতুক অভিনেতা নবদ্বীপ হালদার কৌতুক গীতি ‘শরীরটা আজ বেজায় খারাপ’-এ গানেতে গেয়েছেন – 
“বাগবাজারের রসগোল্লা, ভীমনাগের সন্দেশ,
বর্ধমানের সীতাভোগ, মিহিদানা, দরবেশ।”

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...