অসুর হিরণ্যাক্ষরের উত্তরসূরি ছিলেন রুরু, রুরুর পুত্র দুর্গম অসুর। রুরুর মৃত্যু হয়েছিল দেবতাদের হাতে। সমুদ্রমন্থনে অমৃতের ভাগ পায়নি অসুরকুল। অমৃত না-মেলার ক্ষোভ সঙ্গে পিতা রুরুর মৃত্যুর ক্রোধ, জোড়াফলায় দেবতার উপর প্রতিশোধ নিতে দুর্গম মরিয়া হয়ে ওঠেন। ত্রিলোকের অধিশ্বর হওয়ার নেশায় দুর্গম বেদ দখলের সিদ্ধান্ত নেন। ব্রহ্মার তপস্যা করার বুদ্ধি দেন খোদ দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য। ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় জ্ঞানের ভাণ্ডার যে বেদ। আর তার স্রষ্টা ব্রহ্মা। দুর্গম অসুর ব্রহ্মার তপস্যা শুরু করেন। তুষ্ট হন ব্রহ্মা। অমরত্ব এবং চার বেদের সম্পূর্ণ অধিকারী হওয়ার বর চেয়ে বসেন দুর্গম। ব্রহ্মা, দুর্গমকে চার বেদের অধিকার দেন। তবে অমরত্বের বর তিনি দেননি। বলেছিলেন, কোনও পুরুষ দুর্গমকে বধ করতে পারবে না।
বর মিলতে দুর্গম অসুর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন, দেবতাদের কাছ থেকে স্বর্গের অধিকার ছিনিয়ে নেন। দেবতারা আশ্রয় নেন সুমেরু পর্বতে। ত্রিলোকে নেমে আসে দুর্দশা। দেবতারা তখন শিবের দ্বারস্থ হন। শিবের নির্দেশে দেবী পার্বতী অসুরদলনী উগ্র রূপ ধারণ করেন। বিন্ধ্যাচলে ১০ দিন ধরে দেবীর সঙ্গে দুর্গম অসুরের যুদ্ধ চলে। অবশেষে দুর্গম অসুরের সংহার করেন দেবী। বেদের অধিকার ফিরে পান দেবতারা। দেবরাজ ইন্দ্র ফিরে পান স্বর্গের অধিকার। ত্রিলোকে শান্তি ফিয়ে আসে। দুর্গম অসুরকে বধ করেই দেবী হয়ে ওঠেন দুর্গা। ‘দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা’ অর্থাৎ যিনি ‘দুর্গ’ নামের অসুরের নিধন করেছিলেন, তিনিই দুর্গা।
মহিষাসুরমর্দিনীকে স্মরণ করেই দুর্গাপুজোয় মাতে বাংলা। বঙ্গদেশে মা দুর্গা কি কেবল অসুরদলনী? বাংলায় কোথাও কোথাও তিনি ‘হরগৌরী’ মূর্তিতে পূজিতা হন। চিরাচরিত সিংহবাহিনী রূপ ছেড়ে দেবী ষণ্ডের পৃষ্ঠে আরোহণ করেন। শিবের ক্রোড়ে বসেন তিনি। এই রূপে গোটা পরিবার দেবীর সঙ্গে থাকে। লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী এবং মহাদেব। থাকে না মহিষাসুর। ফলে দেবী অসুরঘাতিনী হিসাবে নন বাড়ির মেয়ে রূপে পুজো না। দেবীর রূপ শান্ত, সৌম্য। দেবী দ্বিভুজা। তাঁর হাতে অস্ত্র থাকে না।
বিডন স্ট্রিটের দত্তবাড়িতে ভোলানাথ ধামে এমন রূপেই দেবী পুজো পান। হিদারাম ব্যানার্জি লেনের দত্ত বাড়িতেও দ্বিভুজা দুর্গার আরাধনা করা হয়। ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি আসেন শিবজায়া। দেবী দুর্গা মহাদেবের বাম উরুতে অধিষ্ঠাত্রী। হরগৌরি রূপে পুজো চলে। বর্ধমানের সাটিনন্দী গ্রামের নাগ পরিবারে দ্বিভুজা মা দুর্গা পূজিতা হন। দেবীর ‘হরগৌরী’ রূপ পুজো পায়। তাঁর এক হাতে বরাভয় মুদ্রা আর অন্য হাতে পদ্ম। দেবী এখানেও সিংহবাহিনী নন। তিনি অধিষ্ঠান করেন শিবের বাহন নন্দীর পিঠে। ইছাপুর নবাবগঞ্জের মন্ডলবাড়িতেও দেবী ষণ্ড পিঠে আরোহণ করে থাকেন। আন্দুলের কুণ্ডু বাড়ি, চুঁচুড়ার শীলবাড়িতে হরগৌরী দুর্গা পুজো হয়। শিবের কোলে মা অবস্থান করেন।
কোথাও কোথাও দেবী অভয়া মূর্তিতেও পূজিতা হন। মহিষাসুর অনুপস্থিত। কিন্তু দেবীর সঙ্গে থাকেন তাঁর সন্তানরা। পটুয়াটোলার ধর বাড়ির দুর্গা দ্বিভুজা, মদনমোহন ধরের হাতে অভয়া দুর্গার পুজো শুরু হয়েছিল। দেবীর পাশে থাকেন লক্ষী, সরস্বতী, কাতিক, গণেশ আর জয়া, বিজয়া। দেবী তো কেবল অসুরদলনী নন, তিনি বরাভয়দাত্রীও বটে। কারণ, তিনি যে মা। তাই দেবী হরগৌরী ও অভয়া দুই রূপেই পূজিতা হন।