বেগম বাহার বা টিবু চায়নাঃ সহজে গাছ বাঁচিয়ে প্রচুর ফুল পাওয়ার অব্যর্থ টিপস

বেগম বাহার, অপূর্ব সুন্দর একটি ফুলের গাছ। দু’পার বাংলার মানুষ তাকে বিভিন্ন নামে চেনেন। কেউ বলেন তাকে ‘টিবু চায়না’ বা ‘টিপু চায়না’, কেউ বলেন ‘দাঁতরাঙা’, আবার কেউ বা বলেন ‘বন-তেজপাতা’। যারা ‘বন-তেজপাতা’ বলেন, তারা বলেন তার তেজপাতার মতো দেখতে পাতার জন্য। এই গাছ পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলির অরণ্যে-পথেঘাটে এবং বৃহত্তর মেদিনীপুরের জঙ্গলে ও জঙ্গল-সংলগ্ন জনপদে স্বাভাবিকভাবে জন্মায়, বড় হয়, ফুল ফোটায়, শোভা বাড়ায়। এই গাছের তিনশোর বেশি প্রজাতি আছে। সেই প্রজাতিভেদে ফুলের আকার-প্রকারে বেশ কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে। রঙও নানান রকমের হয়ে থাকে। সাদা, গোলাপি, বেগুনি, ফিকে বেগুনি প্রভৃতি। তবে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে বেগুনি বা ফিকে বেগুনি রঙের ফুলের গাছ। প্রায় সারা বছরই এই গাছ প্রচুর ফুল দেয় (শীতে অবশ্য ফুলের পরিমাণ কমে)। এক-একটি ফুল পাঁচ-ছ’দিন গাছে থাকে। এবং অপার সৌন্দর্যে বাগান ভরিয়ে রাখে। এ-সব কারণেই কয়েক বছর হল সাধের ছাদ বা ব্যালকনি বাগানিদের মধ্যে এই গাছ চাষ করার খুব আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

বেগম বাহার চাষ করার প্রধান বাধা ও সেগুলো কাটিয়ে ওঠার উপায়

বেগম বাহারের গাছ যারা করতে চান, তাঁদের একটা কমন সমস্যা হল, বার বার গাছ এনেও বাঁচাতে পারেন না। এই সমস্যার একটাই কারণ, এই গাছের স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে ভালোভাবে না-জানা। বিষয়টা একটু সূত্রাকারে সাজিয়ে দিচ্ছিঃ

ক. বেগম বাহার কিন্তু খুব আতুপুতুগোত্রের ফুলটুসি মার্কা গাছ। আপনি যাই-ই করুন, এর শেকড়ে একেবারেই আঘাত লাগানো যাবে না। তাই একে রিপটিং করার সময় অন্য গাছের মতো দুমদাম শেকড় কাটা যাবে না।

খ. এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশে এলে, এই গাছের মানিয়ে নিতে বেশ কিছু সময় লাগে। তাই নার্সারি থেকে আনার পর পরই একে টবে বসাতে যাবেন না। যে পটে বা পলিব্যাগে তাকে এনেছেন, তাতেই তাকে থাকতে দিন পঁচিশ থেকে তিরিশ দিন। নার্সারিতে যদি তাকে সেমিশেডে রাখা হয়ে থাকে দেখেন, তাহলে বাড়িতে এনেও তাকে অন্তত দিনদশেক সেমিশেডে রেখে ফুলসানলাইটে দেবেন একটু একটু রোদ সইয়ে। সইয়ে মানে, প্রথমদিন দু’ঘন্টার জন্য, তারপর প্রতিদিন এক ঘন্টা করে বাড়াবেন। শেষমেশ এমন জায়গায় রাখবেন, যাতে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা বেশ ভালো রোদ পায়। এতে ফুল বেশি হয়।

গ. নার্সারি থেকে আনা পট বা পলিব্যাগ থেকে বেগম বাহারের চারা টবে বসানোর সময় খুব সুন্দর করে চারা পট বা পলিব্যাগ থেকে বের করবেন; যাতে শেকড়ে আঘাত না-লাগে, যাতে গাছের চারপাশের মাটি ঝুরঝুরে হয়ে ভেঙে না-পড়ে। এসব হলে এই গাছ ভীষণ শকড হয়, ঝিমিয়ে পড়ে, মারা যায়।

ঘ. এবার ধরুন, গাছটি পট বা পলিব্যাগ থেকে বের করার সময় অসাবধানতাবশত বা কোনভাবে শেকড় ছিঁড়ে গেল, তখন কী করবেন? তখন গাছটি টবে বসাবার আগে মাটিতে (মাটি কেমন হবে, পরে বলছি) এপসম সল্ট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট এক চা-চামচ ও হাফ চা-চামচ ফাঙ্গিসাইড ছড়িয়ে তার ওপর গাছটি বসাবেন। গাছের শেকড় ও শেকড়ের ছেঁড়া অংশে রুট হরমোন লাগিয়ে দেবেন। তারপর চারার চারপাশ মাটি দিয়ে ভালো করে চেপে দেবেন। তারপর এক মগ জলে হিউমিক এসিড চার-পাঁচ ফোঁটা মিশিয়ে সেই জল টবের মাটিতে ঢেলে দেবেন। এবার টবশুদ্ধ গাছটি ছায়ায় রাখবেন ততদিন, যতদিন না গাছের নতুন শাখা বের হচ্ছে এবং শাখাগুলো হাফ-আঙুল লম্বা হচ্ছে। ছায়া থেকে বের করে আনার উপযুক্ত হলে প্রথমে গাছটি সেমিশেডে এনে রাখবেন, তারপর ধীরে ধীরে সইয়ে সইয়ে ফুল সানলাইটে দেবেন। ফুল সানলাইটে দেওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে একদিন দেড়শো এমএল জলে হিউমিক এসিড তিন ফোঁটা মিশিয়ে টবে দিয়ে যাবেন। গাছ বাঁচানোর এই পদ্ধতিটি বেগম বাহারের ক্ষেত্রে সফল হবার সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ।

ঙ. এবার ধরুন, পলিব্যাগ থেকে বার করার সময় মাটি সব ঝরে গেল, শেকড়গুলো সব কঙ্কালের মতো বেরিয়ে গেল অথবা জঙ্গল বা অন্যকোথাও এই ফুলের গাছ দেখতে পেয়ে চিনতে পেরে তাদের উপড়ে আনলেন; এবার তাদের বাঁচাবেন কীভাবে? এক্ষেত্রে গাছের পাতা ঝিমিয়ে পড়ার মধ্যেই একটি দ্রবণ প্রস্তুত করতে হবে। এক চা-চামচ এপসম সল্ট, হাফ চা-চামচ রুট হরমোন, চার-পাঁচ ফোঁটা হাইড্রোজেন পারক্সাইড, চার-পাঁচ ফোঁটা হিউমিক এসিড, এক চা-চামচের চার ভাগের একভাগ ফাঙ্গিসাইড আড়াইশো এমএল জলে ভালোভাবে গুলে নিতে হবে। তারপর আধো অন্ধকার জায়গায় এতে ছয় থেকে সাত ঘন্টা গাছের কাণ্ড ও শেকড় ডুবিয়ে রাখতে হবে। এই সময়ের পর গাছটির পাতাগুলো সতেজ হয়ে উঠলে গাছটিকে বেলে মাটিতে (এঁটেল এক ভাগ, তিনভাগ মিহি বালি মেশানো মাটি)-তে বসিয়ে দ্রবণটি দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। টবে বসানোর পর পরিচর্যা ‘ঘ’ (আগের) পয়েন্টের মতোই চালিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে জলে হিউমিক এসিডের সঙ্গে তিন ফোঁটা হাইড্রোজেন পারক্সাইড মিশিয়ে সপ্তাহে একবার দিয়ে যাবেন। বেগম বাহারের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে গাছ বাঁচার সম্ভাবনা থাকে সত্তর শতাংশ। 

মাটি তৈরি ও টবে প্রতিস্থাপন

বেগম বাহার গাছ বেশি জল পছন্দ করে না, গোড়ায় জল দাঁড়ানো তো একদমই নয়; কিন্তু শেকড়ের কাছের মাটি স্যাঁতসেঁতে থাকবে—এটা পছন্দ করে। তাই বেগম বাহারের মাটি খুব ঝুরঝুরে, হালকা বেলে-ধরণের তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে একভাগ এঁটেল মাটির সঙ্গে দু’ভাগ মিহি বালি এবং এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর কিংবা পাতাপচা সার ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে মেশাবেন। সেই সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে চার-পাঁচ চামচ কোকোপিট মেশাবেন। এতে শেকড়ের কাছের মাটি স্যাঁতসেঁতে থাকবে। প্রতি টবের হিসেবে দেড় চা-চামচ ফাঙ্গিসাইডও মিশিয়ে দেবেন মাটিতে।

আট থেকে দশ ইঞ্চির টবে প্রথম চারা বসাবেন। টবের নীচে খান-চারেক ফুটো রাখবেন। ফুটোতে খোলামকুচি বসিয়ে তার ওপর এক ইঞ্চি কুচো পাথর সমান করে পুরো তলাটাতে বিছিয়ে দেবেন। তার ওপর পাথর ঢেকে মোটা বালি এক ইঞ্চি সমান করে বিছিয়ে দেবেন। তার ওপর দেবেন মাটি। মাটি দিয়ে টবের আশি-নব্বই ভাগ ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে আগের ‘ক, খ, গ, ঘ’ পয়েন্টে বলা নিয়ম মেনে চারা বসিয়ে দেবেন ও পরিচর্যা করবেন; শেড থেকে ফুলসানলাইটে দেবেন।

জল, রোদ ও খাবার

জল খুব বুঝে বুঝে দেবেন। মাটি শুকনো হয়ে এলে তবেই জল দেবেন। মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি, তাই এই গরমে খুব তাড়াতাড়ি মাটি শুকিয়ে যাবে। তেমন হলে, সকাল-বিকেল দু’বেলা জল দেবেন। মাটি ভেজা থাকলে কখনোই জল দেবেন না, তাতে সহজেই শেকড়ে ফাঙ্গাসের আক্রমণ হয়, পাতার কিনারা পোড়া পোড়া হয়ে যায়, শেকড় পচে যায়, পরিশেষে পাতা ঝরিয়ে গাছ মরে যায়। তাই সাবধান। দু’একদিনের বৃষ্টিতে কিছু হয় না। কিন্তু টানা বর্ষা হলে এই গাছ শেডে সরিয়ে দেবেন। বর্ষায় দশ-পনেরো দিন অন্তর হাফ চা-চামচ ফাঙ্গিসাইড মাটিতে ছড়িয়ে দেবেন।

আগেই বলেছি যে, ভালো ফুল পেতে বেগম বাহারের পাঁচ থেকে ছ’ঘন্টা রোদ চাই। তবে এই গাছ রোদ ভালবাসালেও মধ্যদুপুরের রোদ কষ্ট করে সহ্য করে। তাই গ্রীষ্মে সকাল ও বিকেলের রোদ পায়, এমন জায়গায় টব রাখুন। ছাদবাগানে সেটা সম্ভব না-হলে প্রখর গ্রীষ্মে সকাল-বিকেল দু’বেলা স্নান করিয়ে জল দেবেন।

খাবারের চাহিদা এর বেশ ভালো। শুধু জৈব খাবার দিতে চাইলে দশদিন অন্তর পাতলা করে সরষের খোলপচা জল ও সব্জির খোসাপচা জল অল্টার করে দেবেন। পনেরো দিন অন্তর পাঁচদিনের কলার খোসা ভেজানো জল পাতলা করে দেবেন। কুড়ি-পঁচিশ দিন অন্তর অনুখাদ্য স্প্রে করবেন এক লিটার জলে তিন গ্রাম অনুপাতে মিশিয়ে। মাসে একবার চায়ের পাতাগুঁড়ো এক চামচ মাটিতে ছড়িয়ে দেবেন অথবা এক চা-চামচ কফিগোলা জল মাটিতে ছড়িয়ে দেবেন। রাসায়নিক পদ্ধতিতে কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি বা উনিশঃউনিশ বা পনেরঃপনেরঃপনের ব্যালান্সড এনপিকে প্রতি পনেরো দিন অন্তর এক-চামচ করে আট ইঞ্চির টবে, দশ ইঞ্চির টবে দেড় চা-চামচ পরিমাণে গাছের গোড়া থেকে দূরে দিয়ে যাবেন। প্রতি কুড়িদিন অন্তর মাটিতে এক চা-চামচ এপসম সল্ট ছড়িয়ে দেবেন। মাসে একবার টব প্রতি এক চা-চামচ লাল পটাশ ও এক চামচ ফসফেট টবের ধার ঘেঁষে ছড়িয়ে দেবেন। অনুখাদ্য স্প্রে করবেন মাসে একবার।

পোকা-মাকড় ও রোগবালাই

খুব একটা রোগবালাই এই গাছের নেই। দুটো পোকা ও মাকড় এই গাছকে বেশি জ্বালায়। সাদা মাকড় এবং মিলিবাগ। এদের আক্রমণে অল্পেতেই এই গাছ কাহিল হয়ে পড়ে। তাই মাসে দু’বার নিয়ম করে ডাইমিথোয়েট গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে করে গেলে এই সমস্যায় আর পড়তে হবে না।

এই গাছের ডাল শুকনো হয়ে মরে যাওয়ার একটা সমস্যা দেখা যায়। সেক্ষেত্রে শুকনো হতে থাকা ডালটি কেটে ফেলে কাটা জায়গায় ফাঙ্গিসাইড লাগিয়ে দেবেন।

কাটাই-ছাঁটাই ও চারা তৈরি

এই গাছ হার্ড প্রুনিং-এর সময় শীতের ঠিক আগে অর্থাৎ নভেম্বরের শেষ। তবে প্রুনিং ও রি-পটিং কখনোই একসঙ্গে করবেন না। একসঙ্গে দুটো ধকল এই গাছ নিতে পারে না। অল্প-স্বল্প ছাঁটাই সারা বছরই করা যায়। ফুল হয়ে ঝরে যাবার পর অবশ্যই বৃতি কেটে ফেলে দেবেন। তাতে ডালের সংখ্য বাড়বে, কুঁড়ি বেশি আসবে, ফুলও ঝেঁপে ফুটবে।

মোটা ডাল রুট হরমোন লাগিয়ে বেলেমাটিতে ছায়াযুক্ত জায়গায় পুঁতে চারা তৈরি করা যায়। এছাড়া এই গাছের ফুল থেকে যে ফল হয়, তা পেকে যাবার পর মাটিতে পুঁতেও চারা তৈরি করা যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...