ছাদ বা ব্যালকনিবাগানে মালবেরি গাছে প্রচুর ফল পাওয়ার বিশেষ উপায়

মিষ্টি ও টক-মিষ্টি ফলের মধ্যে মালবেরি বা তুঁত ফল স্বাদে যেমন অসাধারণ, দেখতে যেমন সুন্দর; পুষ্টিগুণেও তেমন অনন্য। সাধের ছাদ বা ব্যালকনিবাগানের টবে এই গাছ খুব সহজেই চাষ করা যায়। স্বাদ, গুণ আর সৌন্দর্যের অপূর্ব সমন্বয়ের জন্যই শখের বাগানে মালবেরি চাষে জোয়ার এসেছে এই কয়েক বছরে। মালবেরির অনেক রকম ভ্যারাইটি রয়েছে; তার মধ্যে কিন্তু দুটি ভ্যারাইটি বাংলায় বেশ জনপ্রিয়ঃ একটির ফলের থোকা বেঁটে ধরণের। এই জাতের ফল পাকলে কালচে রঙের হয়ে থাকে। তখন এর স্বাদ হালকা টক, গাঢ় মিষ্টি। আর অন্য জাতটির ফলের থোকা লম্বাটে ধরণের। এই জাতের ফল পাকলে হলদেটে রঙের হয়ে থাকে এবং এটি তখন দারুণ মিষ্টি হয়। দুই জাতেরই অপূর্ব সুমিষ্ট একটা গন্ধ রয়েছে, যা আমাদের মনকে একেবারে মাতোয়ারা করে তোলে।

মালবেরি খুবই অল্প যত্নে বেশি ফল আদায় করে নেওয়ার মতো গাছ—সে আপনি টবেই করুন বা মাটিতে। তবে এই গাছ থেকে বেশি ফল আদায় করে নেওয়ার সহজ কিছু ট্রিকস আছে, সেগুলো শুধু ফলো করে গেলেই হবে। সেগুলো নিয়েই এবার পয়েন্ট ধরে ধরে আলোচনা করবো, তবে শুরু করবো প্রথম চারা বসানো থেকেঃ  

প্রথমবার গাছ বসানোর জন্য কেমন চারা আনবেন?

মার্চ থেকে শীতের আগে অব্দি যে-কোন সময় মালবেরির চারা টবে বসানো যায়। নার্সারি বা পাড়ার গাছওয়ালার কাছ থেকে মালবেরি চারা নেওয়ার সময় অবশ্যই কলমের চারা কিনবেন। বীজের চারা কক্ষনোই নেবেন না। বীজের চারায় ফল পেতে অনেক দেরি হয়। কিন্তু কলমের চারায় এক বছরেই ফল পাবেন। আর হ্যাঁ, চারা নেওয়ার সময় অবশ্যই সুস্থ, সতেজ, নীরোগ এবং কমপক্ষে তিনটে ডালযুক্ত গাছ কিনবেন। বাড়িতে চারা এনে কমপক্ষে দশদিন রেখে তাকে বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে দেবেন, তারপর তার রিপটিং করবেন।  

উপযুক্ত মাটি কীভাবে তৈরি করবেন?

মালবেরি এক্কেবারে হালকা মাটি পছন্দ করে। জৈবসারসমৃদ্ধ বেলে-দোআঁশ মাটি তাই তার জন্য একেবারে আদর্শ। এই মাটি তৈরি করতে দেড় ভাগ এঁটেল মাটি, দেড় ভাগ সাদা মিহি বালি, এক ভাগ এক বছরের পুরনো গোবর সার বা পাতাপচা সার বা ভার্মি কম্পোস্ট ভালোভাবে মিশিয়ে নেবেন। অবশ্য বাড়িতে পুরনো দোআঁশ মাটি থাকলে তার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ বালি এবং আগের পরিমাণ জৈবসার মিশিয়ে নিলেই হবে। তারপর এর সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে দেড় চা-চামচ সাফ ফাঙ্গিসাইড, এক চামচ নিমখোল, এক চামচ শিংকুচি বা হাড়গুঁড়ো ভালো করে মিশিয়ে নেবেন। এই মাটি আপনি নতুন চারা বসানোর জন্য এবং রিপটিং-এর জন্য ব্যবহার করবেন।

কেমন টবে, কীভাবে চারা বসাবেন?

মালবেরি একটি দীর্ঘস্থায়ী গাছ। গাছের বৃদ্ধি খুব দ্রুত হয়, ঝাড় কাটে। সেই জন্য প্রথমেই একে দশ থেকে বারো ইঞ্চি টবে বসাতে হবে। ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে টবের আশিভাগ আদর্শ মাটি দিয়ে ভর্তি করে ঠিক মধ্যিখানে গর্ত বানিয়ে তার ওপর চারাটি বসিয়ে চারপাশ ভালো করে চেপে মাটি দিয়ে দেবেন। তারপর টবের কানাভর্তি করে জল দিয়ে চার-পাঁচ দিন সম্পূর্ণ ছায়ায় টবশুদ্ধ গাছটি রেখে, তারপর রোদে দেবেন।

কেমন রোদে রাখবেন? জল ও অন্যান্য খাবার কী পরিমাণ দেবেন?

রোদঃ মালবেরি রোদ খুব ভালোবাসে। ডিরেক্ট সানলাইট কমপক্ষে চার ঘন্টা তাকে দিতেই হবে। সারাদিনের রোদ খাওয়ানোর সুবিধে থাকলে, এই গাছ সবচেয়ে বেশি খুশি হয় এবং প্রচুর পরিমাণে ফল দেয়।

জলঃ বর্ষার সময় খেয়াল রাখবেন, গাছের গোড়ায় যেন একেবারেই জল না-জমে। আর সব সময় খেয়াল রাখবেন, কখনোই টবের মাটি খটখটে হয়ে যেন শুকিয়ে না-যায়। এতে এই গাছের ট্রেস হয়। তাই মাটি শুকিয়ে আসছে দেখলেই, এই গাছে জল দেবেন। নতুবা দেবার দরকার নেই।

অন্যান্য খাবারঃ মালবেরিকে খুব মেপে খাবার দিতে হয়। বেশি খাবার দিলে এই গাছে শুধুই পাতার বোঝা হবে, ফলের কিন্তু নাম গন্ধও পাবেন না। তাই এক্ষেত্রে খুব সাবধান। খাবার হয় জৈব পদ্ধতিতে দেবেন, নয়তো রাসায়নিক পদ্ধতিতে দেবেন। মেপে কীভাবে সেই খাবার দেবেন, সেটাই এবার বলছিঃ

জৈব পদ্ধতিঃ পনেরো থেকে কুড়ি দিন পর পর সরষের খোল কমপক্ষে তিনদিন অথবা বাদাম খোল একদিন পচিয়ে দেবেন। একটা কাজ করবেন, হাফ লিটার জলে এক মুঠো খোল দিয়ে পচাবেন। তারপর সেই পচানো খোলজলের সঙ্গে আরও তিন লিটার জল মিশিয়ে সেই জল যতটা প্রয়োজন গাছের টবে দেবেন। অথবা পাঁচশো গ্রামের মতো সবজি ও কলার খোসা এক লিটার জলে পনেরো দিন পচিয়ে ছাঁকনি দিয়ে তরল অংশটা ভালো করে ছেঁকে নেবেন। তারপর ঐ তরলের সঙ্গে আরও ছ’লিটার জল মিশিয়ে গাছে দেবেন।

রাসায়নিক পদ্ধতিঃ উনিশঃউনিশঃউনিশ বা কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি প্রভৃতি সমান রেশিওর যে-সব এনপিকে আছে, সেগুলোর যে-কোন একটা কুড়ি থেকে পঁচিশ দিন অন্তর এক চা-চামচ টবের আধভেজা মাটিতে গাছের গোড়া থেকে দূরে ছড়িয়ে দিয়ে সেই মাটি খুঁচিয়ে দেবেন।

প্রচুর ফল পেতে অত্যন্ত আবশ্যিক ‘ট্রিকস” বা পরিচর্যা কোনগুলো?

ক. বেশি ফল পাওয়ার জন্য কাটাই-ছাঁটাই মালবেরির জন্য অত্যন্ত আবশ্যিক। কোন ডালকেই বেশি বাড়তে দেবেন না। কলমের চারা বসানোর পর যখন দেখবেন যে, ডাল দু’ফুটের বেশি বড় হয়ে গেছে অথচ পাতার কোল থেকে ফলের থোকার কোনও উঁকি-ঝুঁকি নেই; তখন ছ’ইঞ্চি করে রেখে রেখে সব ডাল কেটে দেবেন। কাটা জায়গায় ফাঙ্গিসাইডের পেস্ট লাগিয়ে দেবেন। আর জল ছাড়া অন্যান্য খাবার দেওয়া বন্ধ রাখবেন। এতে দেখবেন, নতুন ডাল যখন গজাবে, তখন তার সঙ্গে ফলেরও দেখা মিলবে।

খ. গাছে ফল দেখা দিলে আবার নিয়ম করে খাবার দেওয়া শুরু করবেন, এতে ফল পুষ্ট হবে, সুস্বাদু হবে।

গ. গাছের এক কিস্তি ফল দেওয়া হয়ে গেলে আবার ছ’ইঞ্চি বা প্রয়োজনমতো এক ফুটের ডাল রেখে, বাড়তি অংশগুলো কেটে ফেলবেন। সমস্ত পাতা ফেলে দেবেন। আবার খাবার দেওয়া বন্ধ করবেন। আসলে, গাছকে এভাবে ছাঁটাই করলে ও খাবার না-দিলে গাছ ভাবে যে, সে-বুঝি আর বাঁচবে না। তখন সে তার জাতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বেশি বেশি বীজ উৎপাদনে মন দেয়। বীজ থাকে ফলের ভেতর; সুতরাং আমরা ফলও বেশি পাই। এইভাবে গাছকে বার বার ট্রেসে ফেলে পুরো মরসুমজুড়ে কয়েকবার ধরে প্রচুর ফল আদায় করে নেওয়া যায়। ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে হয়তো নিষ্ঠুর মনে হতে পারে, কিন্তু সারা পৃথিবীতে দুধ বলুন, মাংস বলুন, ফল বলুন, শস্য বা সবজি বলুন—সমস্ত কিছুর উৎপাদন সার্বিকভাবে আমাদের চাহিদামতো বাড়ানোর পেছনেই কোন-না-কোনভাবে এ-ধরণের আপাত নিষ্পাপ নিষ্ঠুরতা কিন্তু রয়েইছে।

ঘ. গাছে ফল এলে খেয়াল রাখতে হবে, মাটি যেন কখনোই খটখটে হয়ে শুকিয়ে না-যায়। তাতে অসময়ে ফল ঝরে নষ্ট হয়ে যায়।

ঙ. মালবেরির কোন কোন জাত শীতঘুমে যায়, পাতা ঝরিয়ে দেয়; কোন কোন জাত আবার শীতঘুমে যায় না। যারা শীতঘুমে যায়, তাদের সেই সময় প্রয়োজনে জল ছাড়া অন্য খাবার দেবেন না। কারণ, এই সময় পর্যাপ্ত খাবার দিলে গাছ শীতঘুমের পর শুধুই প্রচুর পাতার জন্ম দেয়, ফল দেয় না।         

গাছকে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচানোর উপায় কী?

মালবেরির তেমন কোন রোগবালাই নেই। তবে কখনো-সখনো এই গাছে পাতাখোর লার্ভাজাতীয় পোকাদের আক্রমণ হয়। এরা দিনে লুকিয়ে থাকে, রাতে কচি পাতা ও ডগা খামচা-খামচা খায়। ক্লোরানট্রানিলিপ্রোল ও লাম্বডাসিহ্যালোথ্রিন-জাতীয় কীটনাশক এক লিটার জলে পাঁচ থেকে ছ’ফোঁটা মিশিয়ে স্প্রে করে দিলেই এই পোকারা মরে যাবে।

কাটাই-ছাঁটাই ও রি-পটিং কোন সময় করবেন?

মালবেরির কাঁটাই-ছাঁটাইয়ের কথা তো আগেই বলেছি। এই গাছ খুব দ্রুত বাড়ে, কিন্তু এর শেকড় অতটা দ্রুত বাড়ে না। তাই দেড় থেকে দু’বছরে একবার রি-পটিং এই গাছের জন্য যথেষ্ট। বছরের যে-কোন সময় এটা করা যায়। এক্ষেত্রে সমস্ত ডাল ছেঁটে কাটা অংশে ফাঙ্গিসাইডের পেস্ট লাগিয়ে দেবেন। তারপর পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর শতাংশ শেকড় ছেঁটে আগের চেয়ে এক সাইজ বড় টবে রি-পটিং করবেন। টবের ড্রেনেজ ঠিক রেখে আদর্শ মাটি দিয়ে তার ওপর এক চামচ এপসম সল্ট বা ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর ছাঁটাই করা গাছটা বসিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভালো করে চেপে দেবেন। তারপর টবে কানাভর্তি জল দিয়ে এবং তিন-চারদিন ছায়ায় রেখে তবে টবশুদ্ধ গাছ রোদে রাখবেন।

নতুন চারা তৈরি করবেন কীভাবে?

আঙুল-মোটা শক্ত ডাল থেকে মালবেরির চারা খুব সহজেই চারা তৈরি করে নেওয়া যায়। রুট-হরমোন ছাড়াই কাটা ডাল দোআঁশ বা বেলে মাটিতে পুঁতে দিয়ে মাটি সবসময় হালকা ভেজা ভেজা রাখবেন। তাতেই কুড়ি থেকে পঁচিশ দিনের মধ্যে আপনি মালবেরির নতুন চারা পেয়ে যাবেন।

           

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...