গন্ধরাজের কুঁড়িঝরা সমস্যার সমাধান করে প্রচুর ফুল পাওয়ার সহজ উপায়

শীতকালে সাদা গন্ধরাজ বিশ্রাম নেয়, তাই এই সময় তেমন ফুল দেয় না। কিন্তু বছরের বাকি ঋতুগুলোতে সে প্রাণভরে ফুল দেয়। আর দেয় অপূর্ব সুগন্ধ। এই গন্ধরাজের তিনটে জাতঃ দিশি, চাইনিজ আর হাইব্রিড। এদের মধ্যে সুগন্ধে সেরা হাইব্রিড-ই। ছাদ বা ব্যালকনি বাগানের টবে এই গাছ অল্প যত্নেই বেশ ভালোভাবে করা যায়। কিন্তু এ-গাছ তিনটি সমস্যায় অনেককেই ফেলে থাকে, যেমন—কুঁড়ির দেখা না-পাওয়া, কুঁড়ি ফোটার আগেই ঝরে যাওয়া এবং রোগ-পোকার ঘন ঘন আক্রমণে গাছ নষ্ট হয়ে যাওয়া। আসলে, এই গাছের সঠিক পরিচর্যা না-জানার কারণেই তাঁরা এইসব সমস্যার সম্মুখীন হন, জানলে এইসব সমস্যায় তাঁদের আর পড়তে হবে না। আজকের লেখায় এবার সেই ‘সঠিক পরিচর্যার’ কথাই বলছি স্টেপ বাই স্টেপঃ

উপযুক্ত মাটি তৈরি

মাটি তৈরি করতে হবে গাছের জলের চাহিদা বুঝে। গন্ধরাজ ভেজা ভেজা মাটি পছন্দ করে কিন্তু গোড়ায় জল জমা পছন্দ করে না। মাটিতে বালির অনুপাত ঠিক থাকলে জল জমবে না টবে। আবার মাটিতে কোকোপিট মেশালে তা পরিমাণমতো জল ধরে রেখে টবের মাটি সবসময় ভেজা ভেজা রাখতে সাহায্য করে। তাই আদর্শ মাটি তৈরি করতে সমান সমান অনুপাতে এঁটেল মাটির সঙ্গে বালি ও ভার্মি কম্পোস্ট বা এক বছরের পুরনো গোবর সার বা পাতাপচা সার ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর এই মিশ্রণের সঙ্গে প্রতি টবের হিসেবে চার-পাঁচ মুঠো কোকোপিট, এক মুঠো নিমখোল, এক মুঠো হাড়গুঁড়ো, এক চামচ ইউরিয়া ও এক চামচ পটাশ অথবা দু’চা-চামচ ডিএপি ঝুরঝুরে করে মিশিয়ে নিলেই গন্ধরাজের উপযুক্ত মাটি তৈরি হয়ে যাবে। এই মাটি নতুন চারা বসানো বা পুরনো গাছ রিপটিং সব ধরণের কাজেই ব্যবহার করবেন। এই গাছের জন্য দশ ও বারো ইঞ্চির টব ব্যবহার করবেন, তার চেয়ে ছোট টব নেবেন না। ছোট টবে গাছ ভালো হবে না। টবের ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রাখবেন।

উপযুক্ত রোদ, জল ও খাবার

গন্ধরাজ রোদ খুব ভালোবাসে। দিনে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছ’ঘন্টা ডিরেক্ট সানলাইট তার চাই ভালো ফুল দেওয়ার জন্য। এর চেয়ে কম রোদ পেলে ফুল বেশি হয় না।

গন্ধরাজের টবের মাটি কখনোই যেন খটখটে শুকনো না-হয়ে যায়। প্রচণ্ড গরমে দিনে সকালে জল দিলে দুপুরে যদি তা শুকিয়ে যায়, তাহলে দুপুরে আবার জল দেবেন। মোট কথা, মাটি শুকিয়ে আসছে এমন অবস্থা হলেই জল দেবেন। সেটা সকাল, দুপুর, রাত যখনই হোক। অনেকেই ভুল ধারণায় ভরদুপুরে জল দেন না, ভাবেন তাতে গাছের ক্ষতি হয়। কিন্তু আসলে তা হয় না। আমি দুপুর একটা, দুটো, আড়াইটে ঠা-ঠা রোদে জল দিই মাটি শুকিয়ে গেলে, আজ অব্দি তার জন্য অন্তত কোন গাছ আমার মারা যায়নি।

গন্ধরাজের খাবারের চাহিদা একটু বেশি। তাকে সপ্তাহে একবার সরষের খোলপচা জল দেবেন পাতলা করে। মাসে একবার টব প্রতি এক মুঠো বা এক চামচ রক্তসার দেবেন অথবা সপ্তাহে একবার মাছ বা মাংস ধোয়া জল দেবেন। যত ইঞ্চির টব তত দানা ডিএপি দেবেন বারো দিনে একবার অথবা ঐ একই সময়ের গ্যাপে কুড়িঃকুড়িঃকুড়ি বা উনিশঃউনিশঃউনিশ বা দশঃছাব্বিশঃছাব্বিশ এনপিকে টবপ্রতি দেড় চা-চামচ করে দেবেন। এগুলো দেবেন গাছের গোড়া থেকে দূরে সামান্য মাটি খুঁচিয়ে। এর সঙ্গে মাসে একবার শূন্যঃশূন্যঃপঞ্চাশ এনপিকে বা পটাশ এক চা-চামচ করে টব প্রতি দেবেন। মাসে একবার অনুখাদ্য দেবেন। গুঁড়ো হলে এক লিটার জল দু’গ্রাম, লিকুইড হলে এক লিটার জলে পঁচিশ ফোঁটা মিশিয়ে স্প্রে করে দেবেন।

কুঁড়ি না-আসা, কুঁড়ি ঝরার সমস্যা ও তার সমাধান

পর্যাপ্ত রোদ ও খাবার না-পেলে গন্ধরাজের কুঁড়ি আসে না। তাই উপযুক্ত রোদ আসে এমন জায়গায় টব রাখুন। রুটিন অনুযায়ী খাবার দেওয়া হচ্ছে কি-না খেয়াল রাখুন। এই দুটো শর্ত পূরণের পরও যদি কুঁড়ি না-আসে তাহলে মাসে দু’বার টবের মাটিতে এক চা-চামচ করে পটাশ দিতে থাকুন। খাবার দেওয়ার তিন দিন পর মাসে দু’দিন মিরাকুলান স্প্রে করতে থাকুন। কুড়ি-পঁচিশদিন অন্তর এপসম সল্ট বা ম্যাগনেশিয়াম সালফেট এক চা-চামচ এক লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে থাকুন। অল্পদিনেই নিশ্চিত গাছে ফুল আসবে।

গাছের গোড়ায় জল জমলে এবং টবের মাটিতে ভেজা ভেজা ভাব মেন্টেইন না-করলে অর্থাৎ মাটি মাঝে মাঝেই খটখটে হয়ে শুকিয়ে যেতে দিলে গন্ধরাজ গাছ শকড হয় ও কুঁড়ি ঝরিয়ে দেয়। ফলে, কুঁড়ি ঠিক রাখতে এই দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। এছাড়াও কাটুই পোকা গাছে বাসা বেঁধে কুঁড়ির গোড়া থেকে কেটে তা নষ্ট করে দেয়। এই পোকার আক্রমণ হলে ক্লোরোপাইরিফস গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে করতে হবে, পর পর দু’দিন ভালোভাবে স্প্রে করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

গন্ধরাজের ফুল ফুটে ঝরে যাবার পর থেকে যাওয়া বৃতিটিসহ ডালের ইঞ্চি দুয়েক কেটে ফেলতে হবে। এটা নিয়মিত করতে হবে। এতে ডালে সংখ্যা বাড়বে, গাছ ঝাঁকড়া হবে এবং ফুলের পরিমাণ বাড়বে। একটি গাছ থেকে বেশি ফুল পাওয়ার এটি একটি অন্যতম উপায়।

গন্ধরাজের রোগবালাই

গন্ধরাজে মিলিবাগের আক্রমণ খুব হয়। এক লিটার জলে পাঁচ এমএল শ্যাম্পু গুলে স্প্রে করলেই মিলিবাগ দমন করা যায়। যদি জাবপোকার আক্রমণ হয়, তাহলেও এভাবে তা দমন করা যাবে। এছাড়া ইমিডাক্লোরোপিড গ্রুপের কীটনাশক এক লিটার জলে দুই গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করলেই কাজ হয়ে যায়।

টানা বর্ষায় এই গাছের শেকড়ে ফাঙ্গাসের আক্রমণ হবার আশঙ্কা থাকে। তাই এমন পরিস্থিতি থেকে গাছকে বাঁচাতে এই সময় দশদিন অন্তর টবের মাটিতে আধ চা-চামচ সাফ ফাঙ্গিসাইড বেশ ভালো করে ছড়িয়ে দিতে হবে।

গন্ধরাজ রোদ ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু এপ্রিল থেকে জুন অব্দি প্রচণ্ড দাবদাহে দুপুরের লু ও কড়া রোদ এ-গাছের ক্ষতি করে অনেকসময়ই। এতে গাছের পাতা কুঁকড়ে যায়, পাতার চারপাশ পুড়ে পুড়ে যায়, ফুলের পাঁপড়ির কিনারা পুড়ে পুড়ে যায়, দিনের শেষে ফুলগুলোকে মনে হয় যেন সেদ্ধ সেদ্ধ। এটা বেশি হতে দেখা যায়, ছাদবাগানের গাছে। এক্ষেত্রে টব এমন জায়গায় রাখুন যেখানে মধ্যদুপুরের রোদ সরাসরি আসবে না। সেটা সম্ভব না-হলে সকাল ও বিকেল দু’বেলা গাছকে স্নান করিয়ে জল দেবেন নিয়মিত। তাহলেই হবে।

কাটাই-ছাঁটাই, রি-পটিং ও নতুন চারা তৈরি

গাছ বেঢপ আকারের বেড়ে গেলে তাকে কাটাই-ছাঁটাই করে শেপ দেবার প্রয়োজন হয়। গন্ধরাজের ক্ষেত্রে এটা অনেকেই শীতের শুরুতে করেন, অনেকেই শীতের পর এই ফেব্রুয়ারি মাসেও করে থাকেন। মার্চ মাস থেকে যেহেতু এই গাছ ফুল দেওয়া শুরু করবে, তাই এ-সময় আপনি প্রয়োজনে প্রুনিং করতে পারেন। প্রুনিং করার পর কাটা জায়গায় সংক্রমণ রুখতে অবশ্যই ফাঙ্গিসাইড পেস্ট করে লাগাবেন।

ডালপালার প্রুনিং এবং শেকড় ছাঁটাই একসঙ্গে করবেন না। দুটো ধকল একসঙ্গে গন্ধরাজ অনেক সময়ই নিতে পারে না। দুটোর মধ্যে এক মাসের গ্যাপ রাখবেন।

টবে শেকড় তালগোল পাকিয়ে ওপরের দিকে উঠে আসছে দেখলেই বুঝতে হবে শেকড় ছাঁটাইয়ের সময় এসে গেছে। শেকড় ছাঁটাইয়ের সময় ওপরের দিকের খাদ্যসংগ্রহকারী সরু সরু শেকড়গুলো রেখে অর্থাৎ ওপরের দিকে তিন থেকে চার ইঞ্চি পরিমাণ শেকড় ও মাটি অক্ষত রেখে নীচের অংশটা বিলকুল ছেঁটে ফেলতে হবে। তারপর নতুন টবের ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক রেখে আগের পদ্ধতিতে তৈরি করা মাটি দিয়ে এক চা-চামচ এপসম সল্ট ও আধ চা-চামচ ফাঙ্গিসাইড ছড়িয়ে তার ওপর গাছটি বসিয়ে দিন। এবার চারপাশের মাটি দিয়ে ভালো করে চেপে ভাসিয়ে জল দিয়ে দিন। দিন সাতেক শেডে রেখে টবশুদ্ধ গাছটিকে ফুল সানলাইটে দিন।

ছাঁটাই করা ডাল শীত বাদে বছরের অন্য যে-কোন সময়ই মাটিতে বসিয়ে দিন (গোড়ায় রুটহরমোন লাগাতে পারলে ভালো হয়, না-হলেও তেমন ক্ষতি নেই)। এভাবেই খুব সহজে এক মাসের মধ্যেই তা থেকে পেয়ে যাবেন নতুন গন্ধরাজের চারা।...     

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...