রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে যীশু আরাধনা

ক্রিসমাস ইভের রাতে রামকৃষ্ণ মিশনে চলে যীশু পুজো, বহুদিনের রীতি এটি। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বিভিন্ন শাখায় যীশু পুজো পালিত হয়। যত মত তত পথের দিশারী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তাঁর আদর্শেই রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। প্রতি বছর বেলুড় মঠে সাড়ম্বরে পালিত হয় প্রভু যীশুর পুজো। অন্যান্য উৎসবের মতোই যীশুর আরাধনা করা হয়। কেক, মিষ্টি, পেস্ট্রি, বিভিন্ন ধরনের ফল-সহ পানীয়, চকলেট প্রভৃতি খাদ্য সামগ্রী পরিবেশন করা হয় প্রভুকে। বড়দিনের আগের দিন অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্য আরতির পর, প্রভু যীশুর আরাধনার জায়গাকে সাজিয়ে তোলা হয়, তারপর বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী ও মহারাজরা যীশুর পুজো করেন। রামকৃষ্ণদেবের সামনেই প্রভু যীশুর আরাধনা করা হয়। ক্যারলের মাধ্যমে চলে প্রভু যীশুর আরাধনা। যীশুর ছবির সামনে ফুল, মালা, ধূপধুনো দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সন্ন্যাসী-মহারাজরা ক্যারল গাইতে আরম্ভ করেন। যীশুর পবিত্র আহ্বান, আর রামকৃষ্ণের শিবজ্ঞানে জীব সেবা, দুই'য়ে মিলে এক হয়ে গিয়েছে।

IMG-20231221-WA0018

মঠের নিয়ম মেনে ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আরতির পরেই বিশেষ প্রার্থনা সঙ্গীত, যীশুর জন্মকাহিনী পাঠ, বাইবেল পাঠের মধ্যে দিয়ে এই উৎসব পালন করা হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে প্রায় সব পথের সাধনা করেছিলেন। শৈব সাধনা, শাক্ত সাধনা, বৈষ্ণব সাধনা, বেদান্ত সাধনার পর তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল ইসলামকে জানার। খ্রিস্টানরা কেমন করে ঈশ্বর সাধনা করে, তা জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন ঠাকুর। শম্ভুচরণ মল্লিকের মুখে বাইবেল পাঠ শুনে, খ্রিস্টমতে সাধনা করে সত্য উপলব্ধির ইচ্ছে হয় পরমহংসদেবের। যদু মল্লিকের বাগানবাড়িতে মেরির কোলে ছোট্ট যীশুর ছবি দেখেন ঠাকুর। ছবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঠাকুরের ভাব সমাধি হয়। যা তিন দিন ছিল। চতুর্থ দিনে দক্ষিণেশ্বরে এক ব্যক্তির সংস্পর্শে আসেন তিনি। তাঁর সঙ্গে আলিঙ্গন করতেই, ওই ব্যক্তি বিলীন হয়ে যান। রামকৃষ্ণদেব উপলব্ধি করেন, ওই ব্যক্তিই যীশু। তারপর যীশুর আরাধনা শুরু করেন দক্ষিণেশ্বরের কালীঘরের পরমহংস, সে'সময় তিনি কালীঘরে যাওয়াও বন্ধ করেছিলেন। তাঁর ঘরে হিন্দু দেবদেবীদের সঙ্গে যীশুর একটি ছবি ছিল, তিনি প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় ছবিতে ধূপ-আরতি করতেন।

রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রয়াণের এক সপ্তাহ পর, শ্রীরামকৃষ্ণের পার্শ্বজ শিষ্যদের একটি দল হুগলির আঁটপুরে বাবুরাম মহারাজ অর্থাৎ স্বামী প্রেমানন্দের পৈতৃক বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর অন্যান্য গুরুভাইরা এক শীতের সন্ধ্যায় ধুনি জ্বালিয়ে যীশুর জীবনী এবং তাঁর আত্মত্যাগ নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আলোচনা করতে করতে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত করছিলেন। ওই দিন ধুনি জ্বেলে আগুনের সামনে যীশুর দ্বাদশ শিষ্যর মতো সংসার ত্যাগ করে পরহিতে জীবন উৎসর্গের শপথ গ্রহণ করেন তাঁরা। ঘটনাচক্রে সেই দিনটি ছিল বড়দিনের আগের দিন, ক্রিসমাস ইভ। সেই দিনটি স্মরণ করেই বেলুড় মঠে প্রতি বছর প্রভু যীশুর আরাধনা করা হয় মহাসমারোহে। ২৪ ডিসেম্বর রাতেই আঁটপুরে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের বীজ বপন করা হয়েছিল। বিবেকানন্দ তাঁর শিকাগো বক্তৃতায় এই আঁটপুরেরই এক মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেখানকার রাধাগোবিন্দ মন্দির শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব ধর্মের সমন্বয়ের উদাহরণ। মেরির কোলে যীশুর মূর্তি রয়েছে মন্দিরে। গ্রিস, মিশর ও চৈনিক দেবদেবীর মূর্তিও রয়েছে। 

IMG-20231221-WA0021

রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের কেন্দ্রগুলিতে আজও বড়দিনে যীশুর জন্মোৎসব পালিত হয়। ২৪ ডিসেম্বর আরতির পর শুরু হয় যীশুর আরাধনা, শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরে যীশুর ও মেরিমাতার ছবি মোমবাতি, ফুল দিয়ে সাজানো হয়। লজেন্স, ফল, কেক, পেস্ট্রি ও মিষ্টি দেওয়া হয়। ২৫ ডিসেম্বর ইংরেজি ও বাংলায় বাইবেল ও যীশুর জন্মকাহিনি পাঠ করা হয়। এ'ভাবেই যীশু রামকৃষ্ণের সঙ্গে মিশে গিয়ে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন সকলের আরাধ্য।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...