মা সারদা, তিনি সঙ্ঘজননী, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন দানা বাঁধার অন্যতমা কান্ডারি। জয়রামবাটির সারদা হয়ে উঠেছিলেন অগুনতি পুত্রের জননী। কখনও দক্ষিণেশ্বরের নহবতের ঘর, কখনও বলরাম বসুর বাড়ি আবার শ্যামপুকুর বাটি, কাশীপুর উদ্যান বাটিতে দিন যাপন করেছিলেন মা সারদা। স্থায়ীভাবে কখনও কোথাও থিতু হননি মা। ভাইদের সংসার, ভাইপো, ভাইঝিদের সংসারে থেকেছেন। সেই মায়ের নিজের বাড়ি হল বিশ শতকের দুয়ের দশকে। মায়ের দ্বারি শরৎ মহারাজের চেষ্টায় তৈরি হয়েছিল সেই বাড়ি। আজ সেই দিন, যেদিন মা প্রথম নিজের বাড়িতে পা রেখেছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০২ সালের জুলাই মাসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তারপর থেকে উত্তর কলকাতায় বিভিন্ন বাড়িতে মা সারদাকে থাকতে হয়েছে অস্থায়ীভাবে। তখন স্বামী সারদানন্দ ছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের সাধারণ সম্পাদক। তিনিই মায়ের স্থায়ীভাবে থাকার জন্য বাড়ি তৈরির উদ্যোগ নেন। ১৯০৯ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ দেহত্যাগ অবধি এই ১১ বছর মা ছিলেন বাগবাজারে মায়ের বাড়িতে। 'শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ' লেখার যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল, সেই টাকা দিয়ে মায়ের বাড়ি হয়। সবাই এই বাড়িতেই আসতেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। নন্দলাল বসুর মতো একাধিক কৃতি মানুষেরা এসেছেন এই বাড়িতে। আলিপুর বোমা মামলা থেকে রেহাই মেলার পর বিপ্লবীরা একে একে এসে এখানেই মাকে প্রণাম করেছিলেন। অরবিন্দ ঘোষও সস্ত্রীক এসেছিলেন মায়ের কাছে এই বাড়িতেই। রামকৃষ্ণের পার্শ্বজেরা আসতেন এখানেই, মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। মা এখানে মন্ত্র দীক্ষাও দিয়েছেন অনেক শিষ্যকে। কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে বাগবাজার মায়ের বাড়ি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।
মায়ের বাড়ির জায়গাটি ছিল কেদার দাস মহাশয়ের ছিল। তিনি জমিটি দান করেন। তবে জমি দানের ক্ষেত্রে তাঁর শর্ত ছিল যে, তাঁর দান করা জমিতে রামকৃষ্ণদেবের পুজো করতে হবে। শরৎ মহারাজ এক কথায় রাজি হন। মা থাকবেন ফলে ঠাকুরের নিত্যপুজো হবেই। কিছু দিন নির্মাণ কাজ চলার পর টাকা শেষ হয়ে যায়। মহারাজকে তখন ঋণ নিতে হয়। প্রথমদিকে মা আসতে চাননি। কিছু দিন পর মা নিজেই আসতে রাজি হন। তারপর শরৎ মহারাজ গেলেন এবং মাকে নিয়ে আসলেন। ১৯০৯ সালের ২৩ মে মা আসেন বাগবাজারের এই বাড়িতে। আজ মহাধুমধাম করে মায়ের পদার্পণ তিথি পালন করা হয় বাগবাজারের বাড়িতে।
বাগবাজার সংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে মায়ের স্মৃতি। কাছের মায়ের ঘাট। গঙ্গার ঘাটটি মা ব্যবহার করতেন বাগবাজারে থাকার সময়ে। মা সারদা গঙ্গার ধারে বসে মালা জপ করতেন এবং অনেকটা সময় এখানে থাকতেন। মায়ের নামেই ঘাটের নামকরণ করা হয় মায়ের ঘাট। আজ মায়ের বাড়িতে আসা ভক্তদের আহারের ব্যবস্থা থাকে। মা সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। ধীরে ধীরে এই মন্দির হয়ে উঠেছে পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। বিশ্বজুড়ে ঠাকুর, মা, স্বামী বিবেকানন্দের ভক্তরা নিত্যদিনে এখানে ভিড় করেন। ভক্তদের বিশ্বাস এই বাড়ির ধূলিকণায় মিশে থাকে মায়ের কৃপা, আশীর্বাদ।