মাছ থেকে মাংস, মঠ থেকে রচনা দ্রব্য কী কী থাকে দেবী কালীর ভোগে?

কালীপুজোর ভোগে অধিকাংশ জায়গায় দেবী কালিকার উদ্দেশ্যে অন্ন ভোগ নিবেদন করা হয়। দেবী কালিকার আরাধনা হয় শাক্ত মতে। ভাতের সঙ্গে থাকে ভাজা, তরিতরকারি, মাছ, বলির মাংস, মিষ্টান্ন, পরমান্ন। আদপে কালীর ভোগে কী কী দেওয়া হয়? কালী আরাধনা হয় পঞ্চ ম-র মতে। সাধনা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ‘পঞ্চ ম’ হল মদ্য অর্থাৎ মদ, মাংস, মৎস্য বা মাছ। কারণবারি ছাড়া কালী পুজো অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

এবার মাছের কথা বলি। স্মরণাতীত কাল থেকেই বাংলায় ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে মাছ নিবেদন করা হচ্ছে। ঈশ্বরের ভোগে মাছ নিবেদন করা, বলাবাহুল্য, শাক্তদের মধ্যেই ঈশ্বরের ভোগে মাছ নিবেদন করার রেওয়াজ রয়েছে। তারাপীঠের গোড়ার কাহিনি অনুযায়ী, জয় দত্ত নামে এক বণিক বাণিজ্য করতে বেরিয়ে চণ্ডীপুরে পৌঁছে তরী নোঙর করেন। তখন তারাপীঠ ওই নামেই খ্যাত ছিল। বণিকের সঙ্গে ছিলেন তার ছেলে। হঠাৎই বণিকের ছেলেকে সাপে কামড়ালে, সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হয়। শোকে কাতর বণিক শিবির সেখানেই অবস্থান করতে শুরু করে। তাদেরই একজন লোক জীবিতকুণ্ড পুকুর থেকে একটা শোল মাছ ধরে আনে। মাছ কেটে ওই পুকুরেই ধুতে নিয়ে গেল, ধোয়ার সময়ে কাটা মাছ জোড়া লেগে বেঁচে ওঠে! জয়দত্তর তার লোকদের মরা ছেলেকে নিয়ে পুকুরের জলে ডোবাতে বলে। সেই ছেলে বেঁচে উঠল। সেই থেকে তারাপীঠে শোল মাছ মঙ্গলের প্রতীক হয়ে উঠল। আজও মায়ের ভোগ শোল মাছ ছাড়া অসম্পূর্ণ।

ee7e5414-c830-4d4e-8ce5-ef9b9e62d9e2

মেদিনীপুর জেলার সদর শহর তমলুকের মা বর্গভীমাকে ঘিরেও তারাপীঠের মতোই এক গল্প প্রচলিত রয়েছে। মনে করা হয়, সতীর বাম পায়ের গোড়ালি এখানে পড়েছিল। কথিত আছে, মহাভারতে উল্লেখিত তমলুকের ময়ূর বংশীয় তাম্রধ্বজ রাজাই নাকি এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। জনশ্রুতি রয়েছে, রাজার আদেশে এক দরিদ্র ধীবরপত্নী প্রতিদিন জ্যান্ত শোল মাছ দিতে আসতেন। সারাবছর কীভাবে জ্যান্ত মাছের জোগান দেন ওই ধীবর পত্নী? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রাজা সন্ধান পান দেবীর। ধীবরপত্নী রাজাকে জানান, জঙ্গলে ঘেরা একটি কূপ থেকে জল ছিটিয়েই মরা শোলকে জ্যান্ত করে তিনি নিয়ে আসতেন। ধীবরপত্নীর কথামতো রাজা দেবী বর্গভীমার মূর্তি পান। সেখানেই মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাজা। এখনও এই মন্দিরে মাকে নিবেদন করা হয় শোল মাছের ঝোল। ভক্তরাও মনোবাঞ্ছা পূরণ হলে শোল মাছ নিয়ে মন্দিরে হাজির হন।

শোলের সঙ্গে দেবী কালিকার বেশ সুসম্পর্ক আছে, বাংলার বহু কালী মন্দিরে দেবীকে শোল মাছ নিবেদন করা হয়। শোল, বোয়াল মাছ দিয়ে আজও জলপাইগুড়ির গোশালা মোড়ের দেবী চৌধুরানী শ্মশানকালীর মন্দিরে ভোগ নিবেদন হয়। কালিয়াগঞ্জে বয়রা কালীকে পাঁচ রকম মাছ নিবেদন করা হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, দেবী কালিকার ভোগের পোড়া ল্যাটা মাছ খেয়ে ডাকাতি করতে বেরোতেন রঘু ডাকাত। আজও প্রথা মেনে বাঁশবেড়িয়ার বাসুদেবপুরে রঘু ডাকাতের কালী বাড়িতে ল্যাটা মাছ পোড়া উৎসর্গ করা হয় দেবীকে। আর সেই ভোগ পেতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে মানুষ। কৃষ্ণনগরের দেবী আনন্দময়ী কালীকে নিত্য ভোগে মাছ দেওয়া হয়। শান্তিপুরের প্রাচীন পুজো ঠাকুরপাড়ার জজ-পণ্ডিত বাড়ির পুজো মা পক্কানেশ্বরী কালীকে মাছ নিবেদন করা হয়। মেদিনীপুরের মহিষমর্দিনী ভদ্রকালী মা খেপতেশ্বরী বাড়ির পুকুরের মাছ দিয়ে সেবাড়িতে কালীর ভোগ হয়। বর্ধমানের অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরীর পুজোয় চিংড়ি এবং ইলিশমাছ ভোগ দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। বসিরহাটের ইটিন্ডার সিদ্ধেশ্বরী কালী ইছামতীর গলদা চিংড়ি দেওয়া হয়। বড়বাজারে রয়েছে পুঁটেকালী মন্দির। কালীর নাম কেন এমন হল জানেন? কথিত আছে, মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা মানিকরামের পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে একজন জনৈক খেলারাম, একদা মন্দিরে বসে যজ্ঞ করছিলেন। সেই সময় গঙ্গার খাদ থেকে একটি পুঁটিমাছ লাফিয়ে যজ্ঞকুণ্ডে এসে পড়ে। খেলারাম অর্ধদগ্ধ মাছটিকে তুলে ফের জলে ফেলে দিতেই তা আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। সেই থেকে এখানকার দেবী কালিকার নাম পুঁটিকালী বা পুঁটেকালী।

খাস কলকাতার মন্দিরের মধ্যে বেহালার সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে, বেলগাছিয়া অঞ্চলের তারাশঙ্করী পীঠে মাকে মাছ নিবেদন করা হয়। কালীঘাটেও মাছ দেওয়া হয়, দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন দুপুরে পাঁচ রকমের মাছ নিবেদন করা হয়। লাল মন্দিরে কালী পুজোয় শোল মাছ দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। বীরভূমের ফুল্লরা আর বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দিরে দেবীদের আবার মাছের টক দেওয়া হয়। বর্ধমানের কালীগ্রাম আমাদপুরের বড় মাকে মাছ পোড়া আর মাছের টকের পাশাপাশি রুই মাছের তেল-ঝাল দেওয়া হয়। সবুজ কালীকে ইলিশ দেওয়া হয়। চুনো কালীকে বারো রকমের চুনো মাছ নিবেদন করা হয়।

বলির মাংস নিবেদন করা হয়। বলিদান হাওয়া প্রাণীর ঘাড়ের কাছের মাংস, অর্থাৎ কাঁচা মাংস আর রক্ত নিবেদন করা হয়। পেঁয়াজ, রসুন ছাড়া নিরামিষ পাঁঠার মাংস জিরে ধনে বাটা দিয়ে রেঁধে নিবেদন করা হয়৷

এবার নিরামিষ ভোগের প্রসঙ্গে আসি। নিরামিষ ভোগে থাকে অন্ন ভোগ, পোলাও ভোগ। সাদা ভাত, খিচুড়ি, শুক্তো, শাক, ডাল, পাঁচ রকম ভাজা, পাঁচমিশালী তরকারি, আলু পটোলের তরকারি, ফুলকপির তরকারি, লুচি, ছানার তরকারি, খেজুরের চাটনি, পায়েস, মিষ্টি ৷

তিন বিখ্যাত কালী পীঠের ভোগ: দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর ভোগে সাদাভাত, ঘি, পাঁচরকমের ভাজা, শুক্তো, তরকারি, পাঁচরকমের মাছের পদ, চাটনি, পায়েস ও মিষ্টি নিবেদন করা হয়। এখানে কারণবারির বদলে ডাবের জল দিয়ে মায়ের পুজো হয়।

তারাপীঠ কালী মন্দিরে মা তারাকে দুই বেলাই, দু'বার অন্নভোগ দেওয়া হয়। নিবেদন করা হয় খিচুরি, পোলাও, পাঁচ রকমের ভাজা, তিন রকমের তরকারি, বলির মাংস, পোড়ানো শোল মাছ, চাটনি, পায়েস ও মিষ্টি। সন্ধ্যাবেলায় আরতিতে লুচি ও মিষ্টি নিবেদন করা হয় মা কালীকে।

কালীঘাটের কালীকে বেগুনভাজা, পটলভাজা, কপি, আলু ও কাঁচকলা ভাজা, পোলাও, ডাল, শুক্তো, শাকভাজা, মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস ও চালের পায়েস দেওয়া হয়। রাতে মা লক্ষ্মীকে নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয় কালীঘাটে। লুচি, বেগুনভাজা, আলু ভাজা, দুধ, ছানার সন্দেশ আর রাজভোগ থাকে কালীঘাটের ভোগে।

এছাড়াও কালীর নৈবেদ্যতে থাকে রচনা দ্রব্য, মঠ, আট ভাজা। পুজোতে রচনার হাঁড়ি বলে একটি বস্তুর দরকার পড়ে, তাতে খইয়ের মোয়া, নাড়ু, মুড়কি দেওয়া হয়। দশকর্মার দোকান রচনার হাঁড়ি কিনতে পাওয়া যায়। হাঁড়িটিতে মোয়া, মুড়কি জাতীয় শুকনো খাবার ঠেসে নিবেদন করা হয়। মঠ হল নিরেট চিনির মিষ্টি, শঙ্কু আকৃতির বেশ লম্বা। ছানা যখন পাকঘরের প্রবেশাধিকার পায়নি তখন এই মিষ্টির চল ছিল। আজও ঈশ্বরের ভোগে এটি দেওয়া হয়। আট ভাজা হল আট রকম দানা শস্য ভাজা, মটর, কলাই ইত্যাদি। চানাচুর গোত্রের। অনেকে চাল ভাজাও দেন দেবীকে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...