কালী কথা: খণ্ডঘোষের বড়মা, সপরিবারে পূজিতা হন যে কালী

দুর্ধর্ষ বীর ও লুঠতরাজপ্রবণ মারাঠা জাতি; বর্গীদের রুখে দিয়েছিলেন বাঁকুড়ার সোনামুখীর মাই-তো-কালী। সে কালীর কথা আমাদের সব্বার জানা কিন্তু বর্গী আক্রমণের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে আরও এক কালী মন্দিরের সঙ্গে। পূর্ব বর্ধমানের ওয়ারিতে রয়েছেন বড়মা। তবে দেবী এখানে একা বিরাজ করেন না। সঙ্গে রয়েছে তাঁর পরিবার। একচালির মধ্যে আছে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক এবং গণেশ। আদপে মহামায়ারই দুই রূপ যে কালী ও দুর্গা, তা-ই প্রমাণ হয় খণ্ডঘোষের বড়মাকে দেখলে। এই পুজো খণ্ডঘোষের ওয়ারি গ্রামের সরকার বাড়ির কালীপুজো হিসেবেও খ্যাত। এখন এ পুজো সর্বজনীন। তৈরি হয়েছে বড়মার মন্দির। বছরভর পুজো চলে। 

জনশ্রুতি রয়েছে কালী পুজোর শুরু হয়েছিল স্বপ্নাদেশে। বাংলায় বর্গী আক্রমণের আগে থেকেই এই পুজো হয়ে আসছে। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বর্গী হানার জেরেই ঠাঁইনাড়া হতে হয়েছিল খণ্ডঘোষের বড়মাকে। শ্মশান সংলগ্ন পরিত্যক্ত জায়গায় পড়েছিলেন দেবী। সরকার পরিবারের পূর্বপুরুষ বুধো সরকার ছোটবেলা থেকে ছিলেন কালীভক্ত। মাঠে গরু চরাতে গিয়ে, গরুগুলিকে ছেড়ে দিয়ে, তিনি বটতলার নিচে কালীপুজো খেলা করতেন। এক দিন হঠাৎই বট গাছের ছায়ায় বুধো ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে বড়মার স্বপ্নাদেশ হয়। বড়মা বলেন, তিনি বুধোর ঘরে যেতে চান। দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে পুজোর আয়োজন করার নির্দেশও দেন। 

আরও জানা যায়, স্বপ্নাদেশে কালী নাকি বলেছিলেন, ওই এলাকায় তাঁর মন্দির ছিল। মহাশশ্মান থেকে রায়খা দিঘি অবধি এক টানা ৭৫০ বিঘা জমি সম্পত্তির মালিক ছিলেন দেবী। কিন্তু আজ দেবী ভিখারিণী। দুই মেয়ে লক্ষ্মী, সরস্বতী, দুই ছেলে কার্তিক এবং গণেশ, দুই সেবিকা জয়া-বিজয়াকে নিয়ে তিনি দীর্ঘ দিন অভুক্ত। স্বপ্নদেশে তিনি জানান, তিনি ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে যেতে চান। বলেন তেল মাখিয়ে চালভাজা, মুড়ি আর চিনি দিতে। তা খেয়েই তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন। এরপর ঘুম থেকে উঠে বুধো সরকার বড়মা বলে কেঁদে ওঠেন। সেই কালীপুজো শুরু, আজও এখানে নিত্য পুজো হয়। এখনও রীতি মেনে সন্ধ্যায় নিত্যপুজোর সময় মা কালীকে মুড়ি, মুড়কি, খই দেওয়া হয়। দুর্গাপুজোর সময় অষ্টমী ও নবমীতে কালীপুজো হয়। 

প্রতি বছর কার্তিক অমাবস্যায় অর্থাৎ কালীপুজোর দিন গ্রামে ঘটা করে পুজো হয়। গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সঙ্গে দুই সখী জয়া ও বিজয়াকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠিতা দুর্গা কালীরূপী বড়মা হিসেবেই বিরাজ করেন ও পুজো পান। এখানে পাথরের মূর্তি, গাত্র বর্ণ কালো। পদতলে বিরাজ করেন শিব। দেবীর বির্সজন হয় না। ঘটও বিসর্জন হয় না। কালী পুজোয় ২ দিন পুজো হয়। পুজোয় ২ দিনে মোট ৫টি বলি হয়। পুজোর দিনে ৪টে এবং পরদিন ১টি বলি হয়। আগে মহিষ বলি হত। এখন তা বন্ধ, এখন রীতি মেনে ছাগ, আখ ও ছাঁচি কুমড়ো বলি দেওয়া হয়। বর্গীদের মহিষাসুরের সঙ্গে তুলনা করে বড়মায়ের পুজোয় একসময় মহিষ বলির নিয়ম ছিল। বলির পর মন্দির প্রাঙ্গণে লাঠি খেলায় মেতে উঠতেন গ্রামের হিন্দু ও মুসলমান যুবকরা। এখন মহিষ বলি বন্ধ হলেও প্রথা মেনে কালীপুজোর দিন হয় লাঠি খেলা। 

প্রত্যেক বছর কালীপুজোর দিনে চণ্ডীপাঠ হয়। সন্ধের সময় দেবীকে সাজানো হয়। তারপর পুজো শুরু হয়। তন্ত্রমতে বড়মায়ের পুজো চলে। কালীপুজোর দিন থেকে শুরু করে সাত দিন ধরে চলে বিশেষ পুজো। গ্রামে বিশাল মেলা বসে। নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...