কালী কথা: রামানন্দ প্রতিষ্ঠিত দাঁইহাটের সিদ্ধেশ্বরী কালী

কালী আরাধনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে দাঁইহাট। এই জনপদের নবীন ভাস্করের হাতেই রূপ পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণের ভাবতারিণী। এখানেই পূজিতা হন মা সিদ্ধেশ্বরী। পুজোর শুরু করেন সাধক রামানন্দ। বর্তমানে তাঁর উত্তরসূরিরা এই পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন। কাটোয়ার গঙ্গার অদূরেই রয়েছে দাঁইহাটের সিদ্ধেশ্বরী মায়ের মন্দির৷ গঙ্গার এত কাছে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে দেবী কালিকার পুজোয় কিন্তু গঙ্গাজল ব্রাত্য৷ গঙ্গা জলের বদলে কারণবারি দিয়েই সিদ্ধেশ্বরীর পুজো হয়। তবে মা সিদ্ধেশ্বরী আদপে দক্ষিণাকালী, সেই মতেই দেবী পুজো হয়ে আসছে৷ এটাই ৩৫০ বছরের রীতি।

চারদিনের এই কালীপুজো উপলক্ষ্যে এলাকাবাসী মেতে ওঠেন ৷ সিদ্ধেশ্বরীর মাহাত্ম্য দূর-দূরান্তের গ্রামেও প্রচলিত৷ মায়ের ভক্তি আকর্ষণে দূর-দূরান্তের ভক্তরাও দাঁইহাটের বেড়া এলাকার প্রাচীন সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিতে আসেন৷ কথিত আছে, রামানন্দ নামে এক সাধক দক্ষিণাকালীর প্রতিষ্ঠা করেন৷ সাধক ছিলেন নদিয়া জেলার মাটিয়ারির অধিবাসী৷ গঙ্গার অন্য পাড়ে মাটিয়ারি অবস্থিত৷ সংসারে মন ছিল না, তাই তন্ত্র সাধনায় মন দিয়েছিলেন রামানন্দ। সে'সময় বেড়া গ্রাম ছিল জঙ্গলে ঢাকা। সাধনার জন্য আদৰ্শ স্থান হিসেবে বেড়া গ্রামকে বেছে নিয়েছিলেন রামানন্দ৷ প্রতিদিন গঙ্গা পেরিয়ে রামানন্দ সাধনা করতে আসতেন বেড়া গ্রামে৷ প্রতিষ্ঠা করেন পঞ্চমুণ্ডির আসন৷ দেবীকে ওই আসনে প্রতিষ্ঠিত করে সাধনায় মগ্ন হয়ে থাকতেন রামানন্দ৷ তারপরেই দেবীর পুজোর শুরু হয়। এখানেই কালীর সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন তিনি। তাই দেবীর নাম হয় সিদ্ধেশ্বরী।

রামানন্দ নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁর মৃত্যুর পর কোনও আত্মীয় পুজোর ভার নেন। সেই থেকেই বংশানুক্রমে চলে আসছে সিদ্ধেশ্বরী কালীর পুজো। সাধক রামানন্দের পঞ্চমুণ্ডির আসন আজও আছে মন্দির চত্বরে। রামানন্দের কালী নিয়ম মেনেই পূজিতা হন। রীতি মেনে অমাবস্যায় চালভাজা দিয়ে দেবীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পুজোর শুরু হয়। বিসর্জন হয় ভাইফোঁটার পর দিন। চারদিন ধরেই হয় দেবীর পুজো। 

অন্যদিকে, গোটা বছর মন্দিরে বেদির সামনে ঘট রেখে দেবী কালিকার পুজো চলে। প্রতিদিন অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। কার্তিক মাসে কালীপুজোর সময় জাঁকজমকপূর্ণভাবে পুজো করা হয়। কালীপুজোর সময় তৈরি হয় দেবীর প্রতিমা। ডাকের সাজে সেজে ওঠেন সিদ্ধেশ্বরী কালী। পুজোয় বলির প্রথা রয়েছে। দেবীর পুজো হয় তান্ত্রিক মতে। দেবীকে ভোগে মাছ নিবেদনের চল রয়েছে। ভক্তরা মনে করেন, দেবী খুবই জাগ্রত, তাই নানান মনোবাঞ্ছা নিয়ে তাঁরা পুজোর সময় দেবীর কাছে ছুটে আসেন। 

রামানন্দের পর পরবর্তীকালে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার এই পুজো করে চলেছেন৷ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের এই পুজোকে ঘিরেই এখন আনন্দে মেতে ওঠেন বেড়াবাসী। কার্তিক অমাবস্যায় পুজো হয়, সিদ্ধেশ্বরীর নিরঞ্জন হয় তৃতীয়ার দিন৷ নিয়ম রয়েছে, সিদ্ধেশ্বরীদেবীর পুজোয় জলের পরিবর্তে কারণবারি ব্যবহৃত হয়৷ দেবীকে ইলিশ, মাগুর এবং পোনা, এই তিন রকম মাছের পদ রান্না করে ভোগ দেওয়া হয়৷ ন'পোয়া চাল ভাজা দিতে হয়৷ সিদ্ধেশ্বরী মায়ের পুজোয় ঘট বিসর্জন হয়, প্রতিমা নয়। ভক্ত ও বাসিন্দারা মনে করেন, সিদ্ধেশ্বরী মাতা বড় জাগ্রতা দেবী৷ অনেকেই মানত করেন এখানে৷ মনোবাসনা পূর্ণ হলে পরের বছর পুজো দেন৷ এইভাবেই দাঁইহাটের বেড়াগ্রামে প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূজিতা হয়ে আসছেন সিদ্ধেশ্বরী কালী।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...