কালী কথা: চক্রপুরের কাঞ্চন ডাকাতের সিদ্ধেশ্বরী কালী

আজকের কালীকথায় চক্রপুরের ডাকাত কালীর কথা। আদপে দেবী এখানে মা সিদ্ধেশ্বরী। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই পুজোর বয়স ৩৫৭ বছর। এক সময় এই পুজোয় নরবলি হত। ডাকাতির আগে পঞ্চমুণ্ডের আসনে বসে মায়ের পুজো করতেন ডাকাতদের প্রধান কাঞ্চন সর্দার। নয়টি শব রাখা বেদির উপর অধিষ্ঠান করতেন দেবী। আজও হয় দৈব ও তান্ত্রিক মতে কালীর আরাধনা হয়।

একদা চক্রপুর ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা, এলাকায় একসময় কালী ডাকাতের রাজত্ব চলত। পুরো নাম কালীচরণ মাঝি। তিনিই কালীপুজোর সূচনা করেন। আজও কালী ডাকাতের বংশধররা মা কালী পুজার আয়োজন করে চলেছেন। অন্য একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, চক্রপুরের জমিদার ছিল অত্যাচারী। এলাকায় মানুষদের উপর অত্যাচার চালাত। তখন কালিচরণ জমিদারকে উচ্ছেদ করেছিলেন। তারপরই গ্রামের মানুষজন মহাধুমধাম সহকারে কালীপুজো শুরু করেন। নির্দিষ্ট করে কোনও সন, তারিখের উল্লেখ নেই।

IMG-20240125-WA0095

খানাকুলে চক্রপুরের সিদ্ধেশ্বরী কালী ‘ডাকাত কালী’কে জাগ্রত দেবী হিসেবেই মনে করেন ভক্তরা।এই পুজো, ‘কাঞ্চন ডাকাতের পুজো’ বলেও খ্যাত। একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, কুখ্যাত ডাকাত সর্দার কাঞ্চন মাজির ডেরা ছিল এখানে। কাঞ্চন বড়লোকদের থেকে ধনসম্পদ লুঠ করে গরিবদের সাহায্য করত। কাঞ্চনই স্বপ্নাদেশ পেয়ে চক্রপুর এলাকায় দেবী কালীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে নিয়ম করে মন্দিরে দেবীকে পুজো দিয়ে বের হতেন কাঞ্চন। কাঞ্চনের উত্তরসূরিরা এখনও মন্দিরে নিত্যপুজো করেন। বাইরের কোনও পুরোহিত আসেন না।

চক্রপুরের ডাকাতে কালী মন্দিরে পাশাপাশি দুটি প্রতিমার পুজো হয়। কালী পুজোর দিন রাতে কালী ডাকাতের বংশধরের প্রথম মায়ের ঘট উত্তোলন করেন। তারপর মন্দিরের পুরোহিত আরেকটি ঘট উত্তোলন করেন। দুটি ঘটই মা কালীর পায়ের তলায় রেখে পুজো করা হয়। আজও এ মন্দিরের পুজোয়, রাতের অন্ধকারে ফল চুরি করে মায়ের পায়ে নিবেদন করা হবে। এখন ডাকাত নেই, ডাকাতিও হয় না কিন্তু এই প্রথা চলে আসছে।

চক্রপুরের ডাকাতকালীর থানে কোনও প্রতিষ্ঠিত দেবী বিগ্রহ নেই। প্রতি অমাবস্যায় ঘট স্থাপন করে পুজো করা হয়। প্রতি বছর কার্তিক মাসে অর্থাৎ দীপান্বিতা কালীপুজোর সময় বিরাটকার সিদ্ধেশ্বরী কালী মূর্তি তৈরি করে পুজো করা হয়। আট দিন ধরে সেই পুজো হয়। পুজোর সময় মন্দিরের সামনে বিরাট মেলা বসে। পুজোকে কেন্দ্র করে দুই শতক যাবৎ এখানে মেলা বসছে।

ডাকাতকালীর পুজো করেন ডোমেদের পুরোহিত। পুরোহিতের ডানহাতে একটা বিশেষ তামার বালা পরে পুজো করেন। তামার বালাটি ডাকাত কালীর বালা নামে খ্যাত। জনশ্রুতি রয়েছে, এই বালা পরলে নাকি পাগলদের পাগলামি সেরে যায়। শোনা যায়, বালা ধারণ করে অনেকেই সুস্থ হয়েছে। এই কারণে চক্রপুরের কালী, ডাকাত কালী ছাড়াও খ্যাপা কালী নামেও পরিচিত। প্রতি বছরে কালীপুজোর সময় রোগমুক্তির আশায় দূরদূরান্ত থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ চক্রপুরের এই ডাকাতকালীর মন্দিরে এসে ভিড় জমান। দেবীর কৃপায় সুস্থও হন কেউ কেউ। ডাকাতদের প্রতিষ্ঠিত মা কালী আজ কৃপাময়ী হিসেবে পূজিতা হচ্ছেন।

বন্ধ হয়ে গিয়েছে নরবলি। ব্রাহ্মণদের থেকে আসা ভেট অর্পণ করা হয় মায়ের কাছে। কাঞ্চন সর্দারের সরাসরি বংশধর গীতারানি পণ্ডিত ও তাঁর পুত্র অনিমেষ পণ্ডিত এখন মন্দিরের দায়িত্বে। মাটির মন্দিরের বদলে পাকা মন্দির তৈরি হয়েছে। মন্দিরের সামনে রয়েছে আটচালা। মন্দিরের বাম পাশে আছে সিদ্ধেশ্বরী মায়ের পুকুর। মানুষের বিশ্বাস, পুকুরে স্নান করলেই মনোস্কামনা পূর্ণ হয়।

  • ট্যাগ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...