“রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি৷
অন্যোন্যে বিলাসে রস আস্বাদন করি৷৷
বৈষ্ণব দর্শন অনুসারে কৃষ্ণ ও রাধা অভিন্ন। ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে শ্রীমতি রাধা শ্রীকৃষ্ণের অর্ধাংশস্বরূপা, আবার তিনিই মূল প্রকৃতি; তিনিই সৃষ্টির আধার৷ তাই এই পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং রাধাকে বলেছেন — দুধে যেমন সাদা রঙ মিশে থাকে, অনলে যেমন দহিকা শক্তি বিরাজ করে, গন্ধ যেমন পৃথিবীকে আশ্রয় করে অবস্থান করে; আমিও তেমনি তোমার মধ্যে বিরাজ করছি৷ আমাদের কোনো ভেদ নেই৷
রাধা নামের ‘রা’ শব্দটা রমন শব্দ থেকে এসেছে রমন শব্দের অর্থ হচ্ছে আনন্দ বর্ধনকারী। ‘ধা’ শব্দটা ধারন থেকে এসেছে যার অর্থ ধারন করা। যিনি আনন্দকে ধারন করে থাকেন তিনিই ‘রাধা’। এখানে আনন্দ শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের আরেক নাম সচ্চিদানন্দ। সৎ, চিৎ, আনন্দ।আনন্দ স্বরূপ শ্রীকৃষ্ণকে যিনি মনের মধ্যে ধারন করে আছেন তিনিই ‘রাধা’।
কৃষ্ণপ্রেমী মানুষের মনে যে কৃষ্ণ নামে জগৎ মাতে সেই কৃষ্ণ রাধানামে ব্যাকুল হয়। রাধা কৃষ্ণের হ্লদিনী শক্তি। কৃষ্ণকে নিয়ে মাতে মানুষ। মন্দিরে মন্দিরে পূজিত হন তিনি। কিন্তু ব্রজভূমি আজও আকুল হয় রাধারানীতেই। এই ভূমিতেই আছে রাধারানীতেই।
উত্তরপ্রদেশের মথুরা জেলায় অবস্থিত বারসানা। এই ভূমিতেই রাধারানীর গৃহ। প্রকৃত নাম ব্রহ্মসারণ। সেই নাম লোকমুখে বদলে হয়েছে বারসানা। তীর্থযাত্রীদের কাছে পরিচিত বারসানা ধাম নামে। ভানুগড় পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই মন্দির।
রাধারানীর জন্মভূমি বারসানা। এই ভূমিতেই গড়ে উঠেছে শ্রীজী মন্দির। মান মন্দির, মোর কুটির, কৃষ্ণ কুন্ড, রাধা সরোবর, শংকরী খোর প্রতিটি স্থানই শ্রীজী মন্দিরের সঙ্গে সংযুক্ত। ভূমি থেকে ২৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, শ্রী লাডলি লাল মন্দির নামেও পরিচিত। অপর নামে রাধারানী কা মহল। ব্রজভূমির অন্যতম আকর্ষণ।
আনুমানিক ৫ হাজার বছর আগে শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র ব্রজনাভ গড়েছিলেন এই মন্দির। কিন্তু সেই প্রাচীন মন্দিরটি সময়ের থাবায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৬৭৫-এ বারসানার রাধারানী মন্দির ফের নির্মিত হয় নারায়ণ ভটের দ্বারা। তিনি ছিলেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর অনুগামী। রাজা টোডরমলের অর্থানুকুল্যে মন্দিরটির বর্তমান রূপ দেন।
মন্দির নিয়ে নানা লোককাহিনি প্রচলিত আছে। সেই কাহিনি অনুসারে শ্রীকৃষ্ণের পালক পিতা নন্দ এবং রাধার পিতা বৃষভানু ছিলেন দুই বন্ধু। নন্দ গোকুলের অধিপতি আর বৃষভানু রাওয়াল অধিপতি। মথুরাধিপতি কংসের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁরা সেই ভূমি ত্যাগ করেন। নন্দগাঁও ও বারসানাতে বসতি স্থাপন করে দুই গ্রামের মানুষ। নন্দীশওয়ার এবং ভানুগড় পাহাড়ের চূড়ো বেছে নেন তাঁরা।
সেই সূত্র ধরনে নন্দগাঁও মন্দির নন্দ ভবন এবং বারসানায় শ্রীজী রাধারানী মন্দির।
লাল আর সাদা পাথরে তৈরী মন্দির। লাল আর সাদা রাধা আর কৃষ্ণের প্রেমের বৈপরীত্যের চিহ্ন। স্তম্ভ, খিলানে ঘেরা। মুঘল স্থাপত্যের প্রভাব আছে। ২০০ সিঁড়ি পেরিয়ে প্রবেশ করতে হয় মূল মন্দিরে। বৃষভানু মহারাজ, কীর্তিদা, শ্রীরাধিকার সহোদরা শ্রীদামার মূর্তি চোখে পড়ে। আর আছেন শ্রীমতী স্বয়ং। অষ্টসখীর মন্দিরে সখীসহ পূজিতা হন তিনি। পাহাড়ের উপর মন্দির, অসাধারণ সৌন্দর্য, আর রাইকিশোরীর মায়ায় চোখ টানে।
লাড্ডু মার হোলি, রাধাষ্টমী, শ্রী কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী, লাটমার হোলি, ফুলেরা দুজ এখানে উদযাপিত হয়। কথিত আছে, শ্রীকৃষ্ণ বারসানায় আসতেন শ্রীরাধার সঙ্গে হোলি খেলতে। এই মন্দিরে হোলি তাই অত্যন্ত বিশেষভাবে পালিত হয়। লাঠমার হোলিতে মাতে মানুষ। সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকরা আসে ব্রজভূমিতে হোলি খেলতে।
অক্টোবর থেকে মার্চ এই রাধাক্ষেত্র ভ্রমণের সেরা সময়। এছাড়া উৎসবের সময় প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। বারসানা দর্শন করে মথুরা, বৃন্দাবন এবং গোকুলও যাওয়া যায়। মথুরা থেকে নিয়মিত বাস সার্ভিস আছে।