ইতিহাসের মিষ্টিতে মিশে ভূগোলের গল্প

বাঙালি মাত্রই মিষ্টিপ্রেমি। চিরকাল তারা রসের বশে থাকতে ভালবাসে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলছে সেই ট্র্যাডিশন। মধুমেহর ভয় তাকে কাবু করতে পারেনি। বাঙালি ছানা তৈরি করতে শিখেছিল পর্তুগিজদের কাছ থেকে। তার আগে তারা মিষ্টি বলতে বুঝত চিনির ঢেলার সন্দেশ। তারপর নিজেরাই পরীক্ষানিরিক্ষা চালিয়ে তাকে নানা রূপ দিয়েছে।

 অঞ্চল ভেদে বদলে গিয়েছে মিষ্টির স্বাদ। মিষ্টির সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে তার জন্মস্থানের নাম। অনেক ক্ষেত্রেই মিষ্টি স্থান মাহাত্ম্য বহন করে নিয়ে চলেছে। উৎপত্তির স্থলেই কেবল তাদের দেখা মেলে। মিষ্টি তৈরির রহস্য মন্ত্রের মতো গোপন রাখেন কারিগররা। যাতে মিষ্টির টানে সেই জায়গাতেই ছুটে আসে মানুষ। আবার কিছু  মিষ্টির সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে রাজারাজড়ার গল্প।

সমাজ যেভাবে বদলেছে তার ছাপ এসে পড়েছে জীবন যাত্রাতেও। বদলেছে মিষ্টি। এখন অনেক মিষ্টিই হারিয়ে যাওয়ার বিপন্নতায় ভুগছে। কখনও কারিগরের অভাব, কখনও ক্রেতার অভাব সংকটে ফেলেছে মিষ্টি শিল্পকে। অনেক মিষ্টিই আজ হারিয়ে যাওয়ার মুখে। তবু বাংলার মিষ্টিতেই তার ঐতিহ্য। সেরকমই কিছু মিষ্টির জন্ম বৃত্তান্ত থাকল এই প্রতিবেদনে।     

গুপো সন্দেশ- গুপ্তিপাড়াকে 'গুপ্ত বৃন্দাবন' বলা হত। লোকমুখে নামের বিবর্তন ঘটতে ঘটতে এক সময় এই জনপদের নাম হয় ‘গুপ্তিপাড়া’। গুপ্তিপাড়াতে জন্ম মাখাসন্দেশের। কলকাতার অভিজাত মহলে একসময় তুমুল জনপ্রিয় ছিল এই সন্দেশ। বাড়ির অনুষ্ঠানে গুপ্তিপাড়া থেকে সন্দেশ আনা হত। কাঠের জ্বালে ছানার পাক করে তাত থেকে পিটিয়ে পিটিয়ে জল বের করে দেওয়া হত। সেই ছানা হাতে পাকিয়ে জুড়ে জুড়ে তৈরি হত গুপো সন্দেশ। খেজুর গুড় বা চিনি দিয়ে আনা হত মিষ্টি স্বাদ।  

swt 4

 

লাল দই- বাংলাকে বাকি ভারত চেনে ‘লাল দই’ দিয়ে। ১৯৩০ সালের দিকে নবদ্বীপের জনৈক কালীপদ মোদক, মতান্তরে কালী ঘোষ, এই দই প্রথম প্রস্তুত করেন। কালী ঘোষ এবং হরি ঘোষ দুই ভাই, তাঁরা মূলত দই এবং ঘোল তৈরি করতেন। অল্প আঁচে মোষের দুধে অল্প অল্প জল দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে ফুটিয়ে দুধকে ঘন করতেন। অনেকক্ষণ জ্বাল দেওয়ায় সেই দুধের রঙ লালচে হয়ে যেত। প্রথমে তা ‘ লাল ঘোল’ হিসেবে জনপ্রিয় হলেও পরবর্তী সময়ে তা ঘন হয়ে দই হয়ে যায়। দই কতটা জমাৎ তার ওপরই নির্ভর করে দইয়ের গুণগত মান। হাড়ির মধ্যে ছুরি ঢুকিয়ে দেখা হয় বলে এই দইয়ের আরেকটি নাম হল চাক্কু দই। 

swt 2

 

সাদা বোঁদে- শ্রীরামকৃষ্ণ ভালবাসতেন সাদা বোঁদে। কামারপুকুর ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না এই সাদা বোঁদে। ইতিহাসে বিশদ তথ্য না পাওয়া গেলেও মনে করা হয় ১২০০ বঙ্গাব্দে প্রথম কামারপুকুরে এটি তৈরী।মধুসূদন মোদক এই সাদা বোঁদে তৈরি করতেন।আতপ চালের গুঁড়ি আর বেসনের মিশ্রণকে এক সঙ্গে করে ছোট ছোট দানা তৈরি করা হয়। ঘিয়ে ভাজার পর চিনির রসে ডুবিয়ে  তৈরি হয়ে যায় সাদা বোঁদে। 

swt 5

ছানা বড়া- ২০০ বছর আগে কাশিমবাজারের রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী সাহেবদের মিষ্টি উপহার দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কারিগরদের একেবারে নতুন ধরনের কোনও মিষ্টি তৈরির আদেশ দেন। ছানাকে ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে মণ্ড বানিয়ে ঘিয়ে ভাজেন কারিগররা। সেই ভাজা মিষ্টি গাঢ় রসে ডুবিয়ে দেন। সেই মিষ্টি ইংরেজদের উপহার দেন রাজা। ভাজা মিষ্টির স্বাদে মুগ্ধ হয় তারা। মিষ্টির নাম জানতে চাইলে মণীন্দ্রচন্দ্র বলেন, ‘ছানাবড়া’। যেহেতু ছানাকে ঘি দিয়ে ভাজা হয়েছে, তাই এমন নাম।

swt 3

 

ছানা বড়ার উৎপত্তি নিয়ে আরও একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। ছানাবরার সঙ্গে মুর্শিদাবাদের লাল বাগের নাম ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। নিমাই মন্ডল নামে এক মিষ্টি ব্যবসায়ী এই মিষ্টির জনক।তাঁর দোকান থেকেই মুর্শিদাবাদে নবাবের প্রাসাদে নিয়মিত ছানাবড়া যেত। রুপোর থালায় এক মণ বা দেড় মণ সাইজের ছানাবড়া সাজিয়ে নবাবর অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতেন। এহেন অভ্যর্থনায় অতিথিদের চোখ নাকি ‘ছানাবড়া' হয়ে যেত। সেই থেকে এই মিষ্টির নামই হয়ে যায় ‘ছানাবড়া’।  

স্বামী বিবেকানন্দ ভালোবাস্তেন এই মিষ্টি। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে, মুর্শিদাবাদ থেকে স্বামী অখণ্ডানন্দ বেলুড়ে দু’টি বিশাল ছানাবড়া নিয়ে গিয়েছিলেন। যার ওজন ছিল পাঁচ মণ।   

বাবরসা- বাবরসা মিষ্টি বাংলার প্রাচীন মিষ্টি গুলির মধ্যে একটি। এই মিষ্টি প্রায় ২৫০ বছরের পুরানো। ১৭৫০ সালের আগে কি পরে এই মিষ্টির উৎপত্তি হয়। মিষ্টির উৎপত্তি স্থল মেদিনীপুরের প্রাচীন জনপদ ক্ষীরপাই। এডওয়ার্ড বাবরশ নামে এক সাহেবের নামের অনুকরণে এই মিষ্টির নাম রাখা হয়  ‘বাবরসা’। মূলত ময়দা, দুধ, ঘি দিয়ে তৈরি হয় বাবরসা।

swt 1

১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে বর্গিরা ক্ষীরপাই শহর আক্রমণ করে। সেই সময় এডওয়ার্ড বাবরশ  বর্গিদের হাত থেকে বাসিন্দাদের রক্ষা করেন। সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই তাঁর নামে মিষ্টি তৈরি করেন।

কানসাট - বাংলাদেশের শিবগঞ্জ জেলার প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী মহেন্দ্রনাথ সাহা এই মিষ্টি প্রথম তৈরি করেন। মালদহ এই মিষ্টির স্বাদ পায় তাঁর ছেলে বিজয় সাহার সূত্রে।

swt5

বাংলাদেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জে কানসাট নামে একটি জনপদ আছে। বিজয় সাহা পূর্বপুরুষের জন্মভূমির নাম অনুসারে মিষ্টির নাম রাখেন কানসাটকাঠের আঁচে ছানার পাক করে তার ওপর ক্ষীর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ছানার পাক তৈরি হয় মৌমাছির চাকের মতো।  

কস্তার লাড্ডু-  মানভূম কাশীপুরের রাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেও ভালবাসতেন মিষ্টি খেতে। তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্যই কারিগররা নতুন ধরনের এই মিঠাই তৈরি করেন।   

খোয়া বা ক্ষীরের ময়দা মাশাতে হয়। সঙ্গে জায়ফল, জৈত্রি, লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি, নাগেশ্বরকুসুম ফুল, জাফরান, কেশর গুঁড়োর মিশ্রণ। তা দিয়েই তৈরি হয় এই লাড্ডু। লাড্ডুর আসল জন্মস্থান অবশ্য বেনারস। এই লাড্ডু মানভূম তথা পঞ্চকোট রাজ-পরিবারের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। রাজবাড়িতে বিজয়ার মিষ্টিমুখে এই লাড্ডু প্রজাদের বিলি করতেন রাজা।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...